২ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৫:৩৯

মাদকসেবী শনাক্তের হার বাড়ছে, ৯৯ ভাগই চালক

মাদক গ্রহণকারী শনাক্তকরণ পরীক্ষা বা ডোপ টেস্টে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে বেশিসংখ্যক ব্যক্তি মাদক নিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ২০২২ সালে পরীক্ষা করা ব্যক্তিদের মধ্যে মাদক নেওয়া ব্যক্তিদের হার ছিল প্রায় দেড় শতাংশ। এ বছর তা সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। আর মাদক গ্রহণকারী হিসেবে শনাক্ত ব্যক্তিদের ৯৯ শতাংশই গাড়িচালক।

দেশে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, অস্ত্রের লাইসেন্স, বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা গবেষণা, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার সঙ্গে মাদক পরীক্ষার সনদ জমা দিতে হয়। আবার চাকরিতে থাকাকালে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাঁর ডোপ টেস্ট করাতে পারে।
রাজধানীতে চালকদের বেশির ভাগ ডোপ টেস্ট করা হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে। এর বাইরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ডোপ টেস্ট হয়।

গত বছর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৬৩ জনের ডোপ টেস্ট করা হয়। এর মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দেন এক লাখ ৬৫ হাজার ৮৭৮ জন। চাকরি ও অন্যান্য কাজের জন্য পরীক্ষা করান এক হাজার ৩৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে পজিটিভ বা মাদকাসক্তি শনাক্ত হয় দুই হাজার ১৯৬ জনের।

এর মধ্যে দুই হাজার ১৮৮ জনই ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দেওয়া ব্যক্তি। অর্থাৎ ডোপ টেস্টে মাদকাসক্ত শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের ৯৯.৬৩ শতাংশই গাড়ির চালক। আর মোট ডোপ টেস্টের বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ১.৩১ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, মাদকাসক্তি মস্তিষ্কের ক্রনিক রোগ। কোনো ব্যক্তি মাদকাসক্ত কি না তা যাচাইয়ের জন্য যে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয় তা-ই ডোপ টেস্ট।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়া মানেই মাদকাসক্ত নন। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। বর্তমানে ডোপ টেস্ট করা হয় শুধু মূত্রের নমুনা নিয়ে।

তবে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ মাদকসেবী শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কারণ শুধু মূত্র পরীক্ষায় নমুনা হেরফের করার সুযোগ থাকে। আবার মূত্রের নমুনা সংগ্রহের আগে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করলে বা নমুনা সংগ্রহের ৭২ ঘণ্টা আগ থেকে মাদক গ্রহণ বন্ধ রাখলে এই পরীক্ষায় তা শনাক্ত করা যায় না। এ ক্ষেত্রে রক্ত, চুল বা নক পরীক্ষাসহ বিকল্প পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডোপ টেস্ট মানে কারো জীবিকায় বাধা দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে মাদকসেবী শনাক্তকরণ ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য। সড়ক দুর্ঘটনা কমানো, সমাজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমিয়ে আনাও এর বড় লক্ষ্য।

মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮৫ থেকে ৯০ লাখ। সরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০ লাখ। ২০১৮ সালে সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানো হয়। তখন সরকারিভাবে মাদকাসক্তের সংখ্যা বলা হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ লাখ।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে গত জুন মাসে ডোপ টেস্ট করা হয় আট হাজার ৩৪৭ জনের। এর মধ্যে পজিটিভ হন ৬০৮ জন। এর ৬০৬ জনই গাড়িচালক। এটা মোট পরীক্ষার ৮.৩৪ শতাংশ।

এর আগে মে মাসে একই সেন্টারে ডোপ টেস্ট করা হয় ১০ হাজার ৩৭ জনের। এর মধ্যে মাদকাসক্ত শনাক্ত হয় ৬৩০ জনের। এই সংখ্যা মোট পরীক্ষার ৬.৭ শতাংশ। তাঁদের সবাই গাড়িচালক।

প্রকৃত মাদকাসক্ত ১০ শতাংশের বেশি
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহেদ আলী জিন্নাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ডোপ টেস্ট করছি। এতে পজিটিভ হার গড়ে ৭ শতাংশ। আমাদের ধারণা, এই হার ১০ শতাংশের বেশি হবে। নানা কারণে একটা অংশকে শনাক্ত করা যায় না।’

রেফারেল সেন্টারের পরিচালক বলেন, ‘গত বছর আমরা যখন পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করি তখন শনাক্ত হতো না বললেই চলে। দেখা যেত, মূত্রের নমুনা না দিয়ে তাঁরা ট্যাপের পানি জমা দিয়ে চলে যেতেন। আবার একজনের নমুনা অন্যজন দিয়ে দিতেন। কেউ কেউ বাড়ি থেকে নমুনা নিয়ে আসতেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে ভবনের নিচতলায় যেখানে নমুনা নেওয়া হয় সেখানে পানির কল বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

অধ্যাপক শাহেদ আলী জিন্নাহ আরো বলেন, ‘এখন কিছুটা নিয়মের মধ্যে আসায় শনাক্ত হচ্ছে। কিন্তু এখনো সব চালাকি ধরা পড়ছে না। দেখা যায়, নমুনা দিতে এসে কেউ জুতায়, কেউ পকেটে করে পানি নিয়ে এসে দিয়ে যায়। এ জন্য ওয়াশরুমে লোক রাখতে হয়েছে। আজও (২০ জুলাই) ১৮ জন ধরেছি, যারা বাইরে থেকে একটা নমুনা এনে দিয়েছে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যাদের ডোপ টেস্ট পজিটিভ আসছে, তাদের একবারে কাজ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তাদের আগে কাউন্সেলিং করে আসক্তি কমিয়ে আনতে হবে।

সরেজমিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে ডোপ টেস্ট করতে আসা চালকরা বলেন, এ পদ্ধতিতে তেমন কাজে আসছে না। উল্টো টেস্ট জটিলতায় তাঁরা ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন।

ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে আসা মিরপুরের মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘এই পরীক্ষা ছাড়া এখন লাইসেন্স নবায়ন হয় না। কিন্তু আমার পরিচিত অনেক চালক আছেন যাঁরা মাদক নেন, এখানে পরীক্ষায় পজিটিভ আসেনি। যাঁদের পজিটিভ এসেছে তারা কিছু অপেক্ষার পর আবার পরীক্ষা করিয়েছেন, নেগেটিভ সনদ নিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করে ফেলছেন।’

কবীর হোসেন নামে আরেক চালক বলেন, দালাল দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করলে এসবের কিছুই লাগে না। কিন্তু নিজে করতে গেলে যত ভোগান্তি।

ডোপ টেস্টে কী কী মাদক শনাক্ত করা হয়
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী করা ডোপ টেস্টে নির্দিষ্ট কিছু মাদক শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল, গাঁজা, এলএসডি ও ঘুমের ওষুধ অন্যতম। মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি যদি শেষ ১০ দিনে কোনো মাদক গ্রহণ করে থাকেন তা জানা যায়। এই তথ্য জানিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের সাবেক সহকারী পরিচালক ডা. আবু আহাম্মদ আল মামুন বলেন, সপ্তাহে এক দিন মাদক নিলে মুখের লালার মাধ্যমে, শেষ দুই মাসে মাদক নিলে রক্তের মাধ্যমে, শেষ এক বছরের মধ্যে মাদক নিলে চুল পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়। এ ছাড়া মেরুদণ্ডের তরল (ফ্লুইড) পরীক্ষা করে গত পাঁচ বছরের মধ্যে যদি কেউ মাদক গ্রহণ করে থাকেন তবে জানার সুযোগ আছে। তবে এগুলো দেশে কোথাও হচ্ছে না।

ডোপ টেস্টে পজিটিভ মানেই মাদকাসক্ত নয়
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, যে পদ্ধতিতে বর্তমানে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে তা শতভাগ সঠিক ফল দেয় না। কারণ নমুনা কারো সামনে নেওয়া হয় না। এ ছাড়া পরীক্ষা করতে আসা ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনলাইনে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না।

হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসা মানেই কিন্তু ব্যক্তি মাদকাসক্ত নন। মাদকগ্রহণ আর আসক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবার ডোপ টেস্টে নেগেটিভ মানে মাদকমুক্ত, এটাও বলা যাবে না। কারণ দেশে যে পদ্ধতিতে পরীক্ষাটা করা হয় এর সংবেদনশীলতা কম। তাই কেউ মাদকাসক্ত কি না তা জানতে ডোপ টেস্ট একটা সহায়ক মাত্র।’
ডোপ টেস্ট কোথায় করা হয় ও কত খরচ?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডোপ টেস্টের জন্য সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করেছে ৯০০ টাকা। নন-স্পেসিফিক পরীক্ষা যেমন—বেঞ্জোডায়াজেপিন, এমফেটামাইনস, অপিয়েটস ও কেননাবিনেয়েডস—এই চারটির প্রতিটির ফি ১৫০ টাকা এবং অ্যালকোহল পরীক্ষার ফি ৩০০ টাকা।
রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত ডোপ টেস্ট করার হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।
এ ছাড়া দেশের বেশ কিছু স্থানে ডোপ টেস্ট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে রংপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, রাজশাহী, পাবনা, সিলেট, খুলনা, বগুড়া, গাজীপুর, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, যশোর, নরসিংদী ও টাঙ্গাইল।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/08/02/1304457