১ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:৩৩

জনগণের সম্মতি ছাড়াই তত্ত্বাবধায়ক বিলোপ উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও উপেক্ষিত

সরদার আবদুর রহমান: জনগণের ম্যান্ডেট বা সম্মতির কোনো পরোয়া না করেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছে। এবিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়ে প্রদত্ত নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনে সরকারের নির্বাচনী কোনো ওয়াদাও ছিল না। ছিল না কোনো ইশতেহার। কেবলই দলীয় সুবিধা হাসিলে সংসদে একতরফা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করা হয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে চলমান বিরোধীদলীয় আন্দোলন মূলত মানুষের ভোটের হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য হলেও একে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে নিছক ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’ হিসেবে তুলে আনার চেষ্টা করছে সরকার সমর্থক মহল। সাম্প্রতিক সময়সহ বর্তমান সরকারের আমলের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনগুলো নিছক ভোটারবিহীন রুটিন ওয়ার্কের রূপ নিয়েছে। বিশে^র গণতন্ত্রকামী দেশগুলোর নজরদারির মধ্যেও এই অবস্থা অব্যাহত রয়েছে।

অন্যদিকে আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও গণতান্ত্রিক মানসম্পন্ন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বারবার ‘সংবিধান অনুযায়ী’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে। তাদের ভাষায় সাংবিধানিকতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এবিষয়ে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলে বলছেন, দেশে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন যে পর্যায়ে অধঃপতিত হয়েছে, যেভাবে আইনের শাসন নির্বাহীর শাসনে পরিণত হয়েছে, মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, সেখানে সাংবিধানিকতার যুক্তি পরিস্থিতিকে কি স্বাভাবিকভাবেই আরো জটিল করে তুলবে না? আইনজ্ঞদের অনেকেই এখন কথিত সাংবিধানিকতার যুক্তিকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিপজ্জনক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা বলছেন, এ কাজে সংবিধানের অসাংবিধানিক সংশোধনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জনগণের সম্মতি উপেক্ষা

বিশ্লেষকরা তাদের পর্যালোচনায় দুটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একজন গবেষক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপকারী পঞ্চদশ সংশোধনীকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেন। তিনি সংশোধনী প্রণয়নের প্রক্রিয়া ও ঘটনাক্রম তুলে ধরে বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হলেও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপের কোনো প্রস্তাব ছিল না। ফলে তা ছিল ম্যান্ডেটের বাইরে সম্পাদিত কাজ। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ‘জনগণের সম্মতি’র বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে।
এছাড়াও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণে প্রণীত ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল। আর ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনে সব দলের ভোটের সুযোগ না থাকলেও সংশোধনীটির নেপথ্যে ছিল সর্বদলীয় সমঝোতা বা মতৈক্য। আবার, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপের সময়ে প্রধান দলগুলোর নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। ফলে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ওই সংশোধনীর প্রতি জনসমর্থন ছিল না।
নির্বাহী বিভাগের প্রভাব!

একই গবেষক ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বেআইনি ঘোষণার প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থাকার কথা উল্লেখ করেন। বিশ্লেষণে তিনি বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীকে হাইকোর্ট বৈধ বলে ঘোষণার পর আপিল পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকলেও আপিল বিভাগ তা হঠাৎ করে শুনানি করার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন দল সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের পর। এরপর স্বল্পতম সময়ে তার শুনানি সম্পন্ন করা হয়, যাতে অধিকাংশ অ্যামিকাস কিউরির মতামত উপেক্ষিত হয় এবং আপিল বিভাগের ৪-৩ ব্যবধানে সংক্ষিপ্ত আদেশ দেয়া হয়। এতে আদালতের সিদ্ধান্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সুযোগ দেয়া হয়নি। এছাড়াও পূর্ণাঙ্গ রায়টি এক বছরের বেশি সময় পর প্রকাশ করায় সংখ্যালঘুর মতামত আলোচিত হওয়ার কোনো সুযোগই মেলেনি। অথচ সংক্ষিপ্ত আদেশের দোহাই দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়ে যায়। গবেষক উল্লেখ করেন, আদালত রাজনৈতিক অস্থিরতা এড়াতে পরবর্তী দুটি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য যে অভিমত দিয়েছিলেন, তা উপেক্ষিত হওয়াও সংশোধনীটির বৈধতা ক্ষুণ্ন করে।
সংশোধনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে?

পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক গণ্য করার আরেকটি কারণ হিসেবে গবেষক এতে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র অপরিবর্তনযোগ্য করার অংশটির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাতে এমন কিছু বিবৃতি, দলিল ও ধারণা যুক্ত করা হয়Ñ যা ’৭২-এর মূল সংবিধানে যেমন ছিল না, তেমনই ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগেও ছিল না। অথচ সেগুলো জুড়ে দিয়ে তা সংশোধনের ক্ষমতা ভবিষ্যতের সংসদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার মূল্যায়নে অসাংবিধানিক সংশোধনী রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক দল যেমন করেছে, তেমনই সুপ্রিম কোর্টও ওই প্রক্রিয়ায় অংশীদার হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার প্রশ্ন ভবিষ্যতে আদালতে উত্থাপিত হলে এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও উত্তর মিলতে পারে।

অপর একটি গবেষণায় সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর পর্যালোচনা করে গবেষক উপসংহারে বলেন, এসব সংশোধনী আনা হয়েছে রাজনীতির প্রকৃতি পরিবর্তন এবং শাসক ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে। পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, সংবিধান সংশোধনের জন্য কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই গবেষক পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির ২৯ মার্চ ২০১১-এ অনুষ্ঠিত চতুর্দশ সভার কার্যবিবরণী উদ্ধৃত করে বলেন যে, কমিটির একমাত্র আলোচ্যসূচি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং বিষয়টিতে উঁচু মানের বিতর্ক হয়। বিতর্কের পর সব সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার প্রশ্নে সম্মত হন, কিন্তু তিন মাস পর সংসদ অধিবেশনে কমিটির যে প্রতিবেদন পেশ করা হয়, তাতে ওই সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এতে নির্বাহী বিভাগের নেপথ্য প্রভাবের ইঙ্গিত মেলে। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে বিষয়টিতে আর কোনো অর্থবহ বিতর্ক হয়নি।

সমাধান-সূত্র
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, আদালতের পর্যবেক্ষণ ও মতামত উপেক্ষিত হওয়ায় রাজনৈতিক বিরোধ যে তুঙ্গে উঠেছে এবং জনজীবন ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা গুরুতর বিপদে নিপতিত হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। তারা প্রশ্ন তোলেন, তাহলে সমাধানের জন্য কেনো আদালতের ওই অভিমতকে এখনো প্রাসঙ্গিক গণ্য করা ও তা অনুসরণের পথ অনুসন্ধান করা যাবে না? দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দশম ও একাদশ সংসদের গণ্ডিতে না ভাবলেই তো সেটা সম্ভব। তা ছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের উত্তরসূরি একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর রায় লেখায় তা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে গণ্য করা হয়। অথচ খায়রুল হকের অবসরের প্রায় ১৬ মাস পরে লেখা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় সংবিধান-পরিপন্থী হবে না কেনো পর্যবেক্ষকগণ সে প্রশ্নও তুলছেন।

https://dailysangram.info/post/531426