১ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ৩:২৭

আওয়ামী সরকারের কেয়ারটেকার আতঙ্ক : একটি বিশ্লেষণ

-ড. মো. নূরুল আমিন

কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজবন্দীদের মুক্তি, জুলুম-নির্যাতনের অবসান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জনদুর্ভোগের নিরসন প্রভৃতি দাবিতে বিরোধী দলসমূহের আন্দোলন ও সরকারি দল কর্তৃক তা প্রতিহত করার দীপ্ত ঘোষণায় দেশের রাজনৈতিক ময়দান এখন উত্তপ্ত। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে যে, বিরোধী দলকে কেয়ারটেকার সরকারের স্বপ্ন ভুলে যেতে হবে এবং আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতাসীনদের অধীনেই হবে। সংবিধানে আছে বিদ্যমান সংসদ বহাল থাকা অবস্থাতেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নতুন সংসদের নির্বাচন হবে। সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় আসন খালি হবার আগেই এমপিদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনের নজির দুনিয়ার কোথাও নেই। বিরোধী দলের দাবি হচ্ছে সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করে কেয়ারটেকার সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে তার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। তাদের এই দাবি আজকের নয়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। সরকার এই দাবি মানতে রাজি নন এবং তার অবস্থানে দৃঢ়। ফলে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন জাতি প্রত্যাখ্যান করেছে। তখন বিনাভোটে ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন, মাত্র সাড়ে চার পারসেন্ট ভোটারের উপস্থিতিতে বাকি ১৪৬ জন নির্বাচিত হয়ে গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় এক নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতাসীন দল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন। সরকার যদি তার অবস্থানে অটল থাকেন তাহলে আগামী ডিসেম্বর বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং দেশ সংঘাত-সংঘর্ষের কেন্দ্রে পরিণত হবে। কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা ছিল ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘ তিন বছর ধরে আন্দোলনের একটি অর্জন এবং একটি মীমাংসিত ইস্যু। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত এই ব্যবস্থা ভেঙে দেয় এবং দেশকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। প্রধানমন্ত্রী এজন্য কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন।

কেয়ারটেকার সরকারকে তিনি রাজনীতিকদের দয়ার দান বলেছেন এবং অভিযোগ করেছেন যে, তারা ক্ষমতায় এসে রাজনীতিকদের চোর সাব্যস্ত করেন। এ ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকারে যারা উপদেষ্টা হন তাদের কেউই শেখ হাসিনাসহ রাজনীতিকদের কাছে কখনো এই পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করার জন্য দরবার করেননি। বিচার বিভাগ ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে এই ব্যবস্থাটি প্রবর্তন করে সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল। এটা দয়ার দান ছিল না। ছিল নির্বিঘ্নে নিরপেক্ষ পরিবেশে ভোটারদের নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়। চুরির বিষয়টি ভিন্ন কথা। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী অথবা নির্দলীয় কোনও ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে কিংবা তার বাইরে যদি চুরিচামারি বা দুর্নীতিতে লিপ্ত হন, তাহলে কেয়ারটেকার সরকার হোক কিংবা রাজনৈতিক সরকার, এর বিচার করা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের জন্য সাতখুন মাফ হয়ে যেতে পারে না। এক্ষেত্রে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসন্তুষ্টির কারণ কিন্তু স্পষ্ট এবং কিছুটা অস্পষ্ট। ১৯৯৬ সালের কেয়ারটেকার সরকারের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার কোনও আক্ষেপ ছিল না। কেন না ঐ সময়ে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে তার আক্ষেপ প্রচন্ডরূপ ধারণ করেছিল। কেন না নির্বাচনে জেতার জন্য তিনি সচিবালয় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত প্রশাসনকে যেভাবে সাজিয়ে গিয়েছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমানের কেয়ারটেকার সরকার তা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়ে প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজান। দ্বিতীয় যে কাজটি তিনি করেছিলেন সেটি হচ্ছে শেখ হাসিনার আমলে সন্দেহযুক্ত দুর্নীতিভিত্তিক ব্যয়বহুল কিছু সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটসংক্রান্ত চুক্তি স্থগিতকরণ। এই নির্বাচনে তার দল ফেল করেছিল এবং নির্বাচনে তিনি স্থূল কারচুপির অভিযোগ এনে তার নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান উপদেষ্টাকে মুনাফেক ও বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেছিলেন। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ২০০৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন তার দল ও জোট অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। এই সময় বিচারপতি কেএম হাসানের প্রধান উপদেষ্টা হবার কথা ছিল। কিন্তু তার পক্ষপাতদুষ্ট হবার কোনও সাক্ষ্য প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত না থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা তাকে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আজিজকে গ্রহণ করেননি। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথ বেছে নেন। বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্টকে প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু তাও তারা মেনে নেননি। তাদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বন্দরে অচলাবস্থার সৃষ্টি, লগি-বৈঠার নৈরাজ্য, মানুষ হত্যা প্রভৃতি দেশে জরুরি অবস্থা জারি অবশ্যম্ভাবী করে তোলে এবং সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার তথা এক এগারোর সৃষ্টি হয়। স্বয়ং শেখ হাসিনা এই সরকারকে তার আন্দোলনের ফসল বলে দাবি করেন এবং এর সাফল্যকে নিজের সাফল্য এবং এর ব্যর্থতাকে নিজের ব্যর্থতা বলে অভিহিত করে এই সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন। তার আন্দোলনের ফসল এই সরকারই ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি আখ্যা দিয়ে প্রেসনোট জারি করেছিল। পল্টন হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্তি উল্লেখ করে ঐ সময় একটি চার্জশীট দিয়ে পরে অধিকতর তদন্তের জন্য তা স্থগিতও করা হয়েছিল। এই সরকারের আমলেই মাইনাস টু ফর্মুলার অধীনে তিনি ও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার দেশে প্রত্যাবর্তন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তার আন্দোলনের ফসল সেনা সমর্থিত এই কেয়ারটেকার সরকারের আমলেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারজনিত ১৫টি মামলা রুজু/ পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল এবং ৭টি মামলা বিচার পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

চাঁদাবাজির মামলাসমূহের চার্জশীটে কার কাছ থেকে কখন কোন ব্যাংকের চেক দেয়া হয়েছিল, কে টাকা তুলেছিল তারও প্রমাণপত্রে উল্লেখ ছিল। একইভাবে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছিল এবং তার সংখ্যা ছিল ৪টি। তার দু’ছেলেকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। বেগম জিয়ার মায়ের মৃত্যুর সময় তিনি এবং তার দু’ছেলের প্রতি ঐ সময়ে যে আচরণ করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত নৃশংস এবং সভ্য জগতে বিরল। শেখ হাসিনার ছোট বোন রেহানা, তার ছেলে জয়সহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তার দলের সিনিয়র ও মধ্য সোপানের সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেয়া হয়েছিল। এর অধিকাংশই ছিল ব্যুরো আমলের পুনরুজ্জীবিত মামলা। এতে তাদের অনেকেরই তিন থেকে ৩১ বছরের পর্যন্ত শাস্তি হয়েছিল। বিএনপির অনেক নেতাকেও অনুরূপ বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বিএনপির প্রতি সেনা সমর্থিত এই কেয়ারটেকার সরকার ও তার নিয়োগ করা নির্বাচন কমিশনের আচরণও ছিল বৈষম্যমূলক ও শিষ্টাচার বহির্ভূত। তারা দলটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করে মূল স্রোতধারাকে পঙ্গু করে রাখার চেষ্টা করেছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিএনপি অফিস বন্ধ করে রেখেছিল। বলাবাহুল্য, সেনা সমর্থিত এক এগারোর সরকার কোন অর্থেই সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকার ছিল না। এটা ছিল শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফসল ও তার আশীর্বাদপুষ্ট সরকার। আওয়ামী লীগের থিংকট্যাংক এবং সুশীল সমাজ নামে পরিচিত এদেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা এই সরকারের নাম দিয়েছিলেন Doctrine of Necessity’র সরকার। এই সরকারের এলাইনমেন্টও তারা ঠিক করে দিয়েছিলেন। আঘাতটা শেখ হাসিনার ওপর আসায় তিনি বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং ধারণা করা হচ্ছে যে নিজের ও দলের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। যদিও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সরকারের সকল অবৈধ কাজকে বৈধতা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে তিনি অটল ছিলেন। নিবন্ধের শুরুতে আমি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে শেখ হাসিনার কিছু উদ্বেগের কথা বলেছিলাম। এই উদ্বেগের মধ্যে ছিল তিনিসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও দুর্নীতির বিচার ও জামায়াত নেতাদের দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার না করা। প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াত নেতারা যদি দুর্নীতি না করে থাকেন তাহলে দুর্নীতির দায়ে তাদের কীভাবে গ্রেফতার করা হবে। আমার ধারণা তার আসল আশঙ্কা তা নয়। দুর্নীতিতে তাদের দলের ইমেজ যেভাবে ধ্বংস হয়েছে এবং দুর্নীতিমুক্ত দল হিসেবে জামায়াতের ইমেজ যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে শুধু তিনি কেন, অনেকের আধ্যাত্মিক গুরু ভারতীয় থিংকট্যাংকগুলোও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা মনে করেন যে, নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে সংসদে জামায়াতের শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। প্রসঙ্গক্রমে আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। পাঠকদের হয়ত মনে আছে যে, জনাব আব্দুল জলিল আওয়ামী লীগের শুধু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন না, তিনি প্রথমে চৌদ্দদলীয় জোট এবং পরবর্তীকালে মহাজোটের সমন্বয়কারী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। (চলবে)

https://dailysangram.info/post/531401