৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:৩৫

তবু বিদেশে উচ্চশিক্ষা প্রশিক্ষণে যেতে চান সরকারি কর্মকর্তারা

অর্থনৈতিক সংকটে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বন্ধ রেখেছে সরকার। কিন্তু চলতি অর্থবছর থেকে কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে অর্থসচিবকে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

গত ২ জুলাই এই চিঠি দেওয়া হয়। গত বছরের নভেম্বরেও একই রকম চিঠি অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছিল জনপ্রশাসন।
সেই প্রস্তাবে সায় দেয়নি অর্থ বিভাগ।

বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম ধাপ ২০০৯ সালে শুরু হয়। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি শেষ হলে দ্বিতীয় পর্যায় হাতে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২২ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শেষ করার পরিকল্পনা ছিল।

কিন্তু করোনা মহামারির কারণে মেয়াদ তিনবার সংশোধন করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, প্রথম আট বছরে প্রকল্পে দুই হাজার ১৫৬ জন কর্মকর্তার উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ২৬২ কোটি ১৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যয় ধরা হয় ২৯০ কোটি ২০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৮৮৯ জন কর্মকর্তা।

করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক সংকটের কারণে প্রত্যাশিত বিদেশ প্রশিক্ষণ না হওয়ায় প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫৫২ কোটি ৩৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

২০২২ সালের ১২ মে থেকে বিদেশে সব ধরনের প্রশিক্ষণ বন্ধ রেখেছে সরকার। এরপর সরকারের কৃচ্ছ সাধনের অংশ হিসেবে গত বছরের ৩ জুলাই দেশেও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করার নির্দেশনা দেয় অর্থ বিভাগ। গত বছরের ৯ নভেম্বরেও বিদেশ ভ্রমণ বন্ধসংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত ২ জুলাই অর্থ বিভাগের এক পরিপত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ, ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণ বন্ধ থাকবে।
ওই পরিপত্র জারির দিনই সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ চালু করতে অর্থসচিবকে চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়/প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সিভিল সার্ভিসের মানবসম্পদ বিকাশ ও উন্নয়ন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই চলতি অর্থবছর থেকে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ দ্বিতীয় পর্যায় (দ্বিতীয়বার সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা, রিফ্রেশার কোর্স ও প্রশিক্ষণ চালুর অনুমতি চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব (বাজেট-৩) তারিকুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিদেশ প্রশিক্ষণ চালুর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে আবেদন করেছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রশিক্ষণ পাওয়া ৭০% প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য
এই প্রকল্পের আওতায় যেসব কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের ৭০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। সরকারের বাকি ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ১৪ বছরে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়া তিন হাজার ৪৫ কর্মকর্তার মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা দুই হাজার ১৩২ জন। বাকি ২৫টি ক্যাডারের ৯১৩ জন কর্মকর্তা বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয়বার মাস্টার্স ডিগ্রি করেছেন এক হাজার ৩৪ জন। ডিপ্লোমা ডিগ্রি করেছেন ১৪৯ জন। ১৫ থেকে ২০ দিনের প্রশিক্ষণ (শর্ট কোর্স) নিয়েছেন এক হাজার ৮৩০ জন। আর পিএইচডি করেছেন ১৩ জন।

সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের উদ্দেশ্য হলো প্রশাসনের সব ক্যাডারকে এগিয়ে নেওয়া। তিন হাজারের বেশি কর্মকর্তা বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিলেও দেশের বড় প্রকল্পগুলোতে নিয়োগ পাচ্ছেন বিদেশি পরামর্শক। কিছু কর্মকর্তা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কাজে পদায়ন পেলেও মূল দায়িত্বে থাকেন বিদেশিরা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেহেতু বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে, তাই তা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিদেশে প্রশিক্ষণ চালু বা বন্ধ রাখার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

মানা হচ্ছে না আইএমইডির সুপারিশ
এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষে কিছু সুপারিশ করেছিল সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ-আইএমইডি। তারা সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগভিত্তিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা (নিড অ্যাসেসমেন্ট) করার সুপারিশ করেছে। সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের চাহিদা তৈরি করে কোন কাজের জন্য কতজন কর্মকর্তার কী কী বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় নিরূপণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলেছে তারা। এর জন্য জনপ্রশাসনের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশও করা হয়। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।

২০২২ সালে ২২ জন সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে ছয় মাসের মধ্যে তাঁদের বেশির ভাগ অবসরে চলে গেছেন। বাকি অনেক কর্মকর্তা যে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সে অনুযায়ী পদায়ন পাননি বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। একই অবস্থা অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিবদের।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাঁদের প্রশিক্ষণ কতটা কাজে লাগাচ্ছেন তা তদারকি কিংবা এ নিয়ে জরিপ সম্পর্কে জেনে বলতে হবে। তবে পদায়নের ক্ষেত্রে অর্জিত ডিগ্রিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। যাঁদের চাকরি এক বছর থেকে ছয় মাস আছে তাঁদের প্রশিক্ষণ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত আছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজে লাগালে দেশের মঙ্গল হতো। এ জন্য অবশ্যই মহাপরিকল্পনা, জরিপ ও তদারকি দরকার। এ ছাড়া খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) পদ্ধতি চালু করতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও ট্রেনিং (সিপিটি) বিভাগ শুধু এসব বিষয় নিয়ে কাজ করে। তবে সিপিটি বিভাগ হয়তো জনবলের অভাবে কাজ করতে পারছে না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/07/31/1303783