৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:৩২

পোস্ট ডেঙ্গু ক্লিনিক কার্যক্রম নেই

২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২,৭৩১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু ৮

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের জটিলতা তুলনামূলক কম। তবে কোমরবিডিটি তথা দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তদের জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গু থেকে সুস্থতা-পরবর্তী তাদের অনেকে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চিকিৎসকের দারস্থ হচ্ছেন।

কিন্তু হাসপাতালগুলোতে পোস্ট ডেঙ্গু ক্লিনিক না থাকায় সংশ্লিষ্ট রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এদিকে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে আরও ২ হাজার ৭৩১ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি, ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জুলাইয়ের ৩০ দিনেই ভর্তি রোগী ৪১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় ২০০ জনের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা চলতি বছর একদিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ নিয়ে মোট ভর্তি রোগী ৪৯ হাজার ১৩৮ জনে পৌঁছেছে।

২৪ ঘণ্টায় আরও ৮ জনের মৃত্যুতে মোট মৃতের সংখ্যা ২৪৭। এর মধ্যে চলতি জুলাইয়ে মারা গেছেন ২০০ জন। জুনের তুলনায় জুলাইয়ে সাত গুণের বেশি ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় করোনাভাইরাসের মতো ডেঙ্গুর টিকা দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ১৭ জুলাই গাজীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হন সাইফুল্লাহ আমান (৩০)।
২৫ জুলাই ডেঙ্গু নেগেটিভ হলে চিকিৎসকরা হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেন। কয়েকদিন পর ফের জ্বর আসে। এবার ঢাকা মেডিকেলের একজন চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। রোববার তিনি এ প্রতিবেদকে বলেন, জ্বর সারলেও এখনো তীব্র শরীর ব্যথায় ভুগছেন। শুরুতে কথা বলতেও কষ্ট হতো। দাঁড়ালে মাথা ঘোরার সঙ্গে তীব্র মাথাব্যথা করে।

তিনি জানান, তার মতো অনেকেরই ডেঙ্গু-পরবর্তী জটিলতা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই পোস্ট ডেঙ্গু ক্লিনিক না থাকায় ভোন্তিতে পড়তে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বি যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার-পরবর্তী তেমন জটিলতা তৈরি হয় না।

ডেঙ্গুর শুরুতেই একিউট প্রবলেম দেখা যায়। এখনো বিএসএমএমইউতে ডেঙ্গু ক্রনিক প্রবলেমের কোনো ডকুমেন্টেশন পাওয়া যায়নি। তবে কোমরবিডিটি (দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ) সম্পন্নদের একটি গ্রুপের এক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম হয়। তাদের জ্বর ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভাইরাল অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে। যেটি এখন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এতে মৃত্যুহারও বেশি হয়।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, এক্সপান্ডেন্ট ডেঙ্গু সিনড্রোম রোগীদের হার্ট, নার্ভ সিস্টেম, অন্ড্রো, অগ্নাশয়ে ভাইরাল অ্যাটাক করে। এ ধরনের জটিলতায় রোগীর রেসিডিউয়াল সমস্যা দেখা দিতে পারে।

তাছাড়া ডেঙ্গুসহ যে কোনো ভাইরাল ফিভারে সুস্থতা-পরবর্তী ভাইরাল অ্যাপথেনিয়াজনিত দুর্বলতা থাকতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে এ দুর্বলতা চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। চিকিৎসা পরিভাষায় যেটিকে ‘ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম’ বলে।

এছাড়া ডেঙ্গুতে স্বল্পসংখ্যক রোগীদের বোনম্যারো সাপ্রেশন হতে পারে। তাদের প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রায় উঠতে মাসখানেক সময় লাগে। ডেঙ্গুতে অগ্নাশয়ের প্রদাহ হলে কোনো ক্ষেত্রে রোগীর তলপেট ব্যথা হওয়ায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিতে দেরি হয়।

কারও ডেঙ্গু থেকে ব্রেন ইনফেকশন বা প্যারালাইসিস হলে পরে দীর্ঘমেয়াদি ফলোআপ ট্রিটমেন্ট লাগে। তাদের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অথবা ইনফেকশাস ডিজিজ স্পেশালিস্টেও ফলোআপে থাকা উচিত। বড় হাসপাতালগুলোতে পোস্ট ডেঙ্গু ক্লিনিক চালু করা দরকার।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এর আগে এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের সুস্থতা-পরবর্তী অস্থিসন্ধি ব্যথা ও বিভিন্ন ধরনের বাতের সমস্যাসহ বেশকিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। তখন লং চিকুনগুনিয়া সিনড্রোম চিকিৎসায় অনেক হাসপাতালে পোস্ট চিকুনগুনিয়া ক্লিনিক খোলা হয়েছিল।

অন্য কোনো রোগ না থাকলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর তেমন সমস্যা হয় না। তবে যে কোনো পোস্ট ভাইরাল সিনড্রোম-পরবর্তী কয়েকদিন দুর্বল, অবসন্নতা, হালকা মাথা ঘোরার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি ক্ষণস্থায়ী। এক্ষেত্রে ডায়াবেটিস, হার্ট ও ক্যানসার রোগীদের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। প্রথমবার আক্রান্তের চেয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্তদেরও ঝুঁকি বেশি। পুনরায় যেন কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত না হন, এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

পোস্ট ডেঙ্গু সিনড্রোমযুক্তদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু রোগীর হার বৃদ্ধি ও রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার একটি কারণ হতে পারে অতীতের তুলনায় ঘন ঘন নতুন ডেঙ্গু সেরোটাইপের পুনরাবির্ভাব হওয়া। এ কারণে দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে ভাবছে সরকার : এ বছর জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় সরকার রোগটি মোকাবিলায় ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে ভাবছে। রোববার ডেঙ্গু পরিস্থিতিবিষয়ক সভায় এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক শাহাদাত হোসেন। তিনি জানান, ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে এডিস মশাবাহিত এ ভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কার্যক্রমের বিষয়টি বিবেচনায় আছে। তবে সরকার এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

এর আগে বুধবার চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলায় মশা নিধনের পাশাপাশি ডেঙ্গুর টিকা প্রয়োগে মনোনিবেশ এবং এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নীতিনির্ধারকদের তাগিদ দেন ভাইরোলজিস্টরা।

তারা জানান, ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে এ টিকা অনুমোদন পেয়েছে। টিকাগুলোর ডেঙ্গু প্রতিরোধ সক্ষমতা ৮০ শতাংশের ওপরে। ৯০ শতাংশ টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/701736