৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:২৩

মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবির যৌক্তিকতা

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শিক্ষকরা ১১ জুলাই থেকে রাজপথে জাতীয়করণ দাবি আদায়ে আন্দোলন করছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষকরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে তালা দিয়ে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী ও মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের সাথে শিক্ষকনেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দাবি মানার কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি; বরং শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর বার্তাতেও অনড় শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয়করণ সম্ভব নয়। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দু’টি কমিটি গঠিত হয়েছে। শিক্ষকনেতারা মনে করছেন, এটি আন্দোলন বন্ধ করার একটি প্রয়াস মাত্র। বাংলাদেশের ৫২ বছরে নানা পর্যায়ে আন্দোলন করে বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক ও ন্যায্য। তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্বল্প সময়ের জন্য দেখা করতে চান কিন্তু অনুমতি মিলছে না।

বেসরকারি শিক্ষকরা নানা পর্যায়ে বঞ্চনার শিকার। অথচ একই কারিকুলামের অধীন একই কাজে নিয়োজিত থেকেও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে পাহাড়সম বৈষম্য। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার তুলনা করলে একটি হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ফুটে ওঠে। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন ১৬ হাজার টাকা আর বেসরকারিদের ১২ হাজার ৫০০। সরকারি শিক্ষকদের চিকিৎসা ভাতা এক হাজার ৫০০ টাকা; অপর দিকে বেসরকারি শিক্ষকদের মাত্র ৫০০ টাকা। সরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ আর বেসরকারি শিক্ষকদের মাত্র এক হাজার টাকা। সরকারি শিক্ষকদের উৎসবভাতা মূল বেতনের শতভাগ আর বেসরকারি শিক্ষকদের মাত্র ২৫ শতাংশ। সরকারি শিক্ষকদের অবসরকালীন এককালীন ভাতা মূল বেতনের ৯০ শতাংশের ৩০০ গুণ, পক্ষান্তরে, বেসরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের ৭৫ গুণ। সরকারি শিক্ষকদের অবসরকালীন মাসিক ভাতা চিকিৎসাভাতাসহ মূল বেতনের ৯০ শতাংশ আর বেসরকারি শিক্ষকদের কোনো ভাতা নেই। সরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধার জন্য কোনো চাঁদা জমা দিতে হয় না অপর দিকে, বেসরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ চাঁদা হিসেবে জমা দিতে হয়।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বেতন স্কেল সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বেতন স্কেলের এক ধাপ নিচে দেয়া হয়। তা ছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল না দেয়ায় উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বেতন স্কেল ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল সমান। এতে সহকারী প্রধান শিক্ষকদের মধ্যে দীর্ঘ দিনের অসন্তোষ রয়েছে। ইউনেস্কো ও আইএলওর সুপারিশমালা মোতাবেক সমযোগ্যতা, সম-অভিজ্ঞতা ও সমদায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এক ও অভিন্ন বেতন স্কেলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হবেন। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য গঠিত অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অবসরে যাওয়ার চার বছরের মধ্যেও কোনো শিক্ষক তার প্রাপ্য টাকা পান না। এ সময়ে অনেকে মারাও যান। বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সব শিক্ষক ফুঁঁসে উঠছেন। দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বেসরকারিভাবে। দেশের মূল শিক্ষাধারার সাথে বেসরকারি শিক্ষকরা সম্পৃক্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সব বৈষম্য দূর করার একমাত্র সমাধান শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ।

শিক্ষকরা দাবি করছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা জাতীয়করণ হলে সরকারের এক টাকাও বাড়তি খরচ হবে না। বর্তমানে এমপিও হিসাবে দেয়া অনুদানের অর্থে ব্যয় সঙ্কুলান হবে। এর সাথে কেবল প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় যোগ করতে হবে। এই দুই অর্থ মিলিয়ে শিক্ষকের বেতনভাতা সব দেয়া যাবে। এরপরও বছরে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার মতো সরকারের তহবিলে জমা থেকে যাবে।

বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২০ সহস্রাধিক। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬৮৪টি, বাকি ১৯ হাজার ৩১৬ বেসরকারি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী এক কোটি এক লাখ ৯০ হাজার ২২। মোট শিক্ষক আছেন পৌনে তিন লাখের মতো। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ এমপিওভুক্ত। এর মানে হলো- এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশসহ কিছু ভাতা পান। দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে দাবি-দাওয়াসংবলিত স্মারকলিপি অনেকবার পাঠানো হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপের প্রতি খুব হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

জাতিসঙ্ঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর মূল্যায়ন হলো- শিক্ষার মান বাড়ানোর ওপর সরকার জোর দিলেও শিক্ষা খাতে অর্থায়ন পর্যাপ্ত নয় ও সমতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। সরকারের উচিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য এমন একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা। সম্প্রতি ঢাকার একটি হোটেলে সংস্থাটির ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট’ তুলে ধরার সময় প্রতিবেদনের পরিচালক ম্যানোস আন্তোনিনিস নিজেদের এ মূল্যায়নের কথা প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। পাকিস্তানে এ হার ৫৭ শতাংশ, আর নেপালে ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি সংস্থার স্কুলে তিনগুণ এবং বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেনে নয় গুণ বেশি ফি পরিবারগুলোর গুনতে হয় বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

বহুমুখী সমস্যা, বঞ্চনা ও অসঙ্গতির মাধ্যমে পরিচালিত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা যতই দিন যাচ্ছে ততই পরিচয় সঙ্কটে আবর্তিত হচ্ছেন। এর সাথে নতুন করে যোগ হচ্ছে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যে সিলেবাস, কারিকুলাম ও কোর্স পাঠদান করান ঠিক সেই সিলেবাস, কারিকুলাম ও কোর্সই পাঠদান করান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরাও। অথচ সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল তফাত। শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষাপ্রশাসনের সব ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের ডেপুটেশনে পদায়ন নেয়ার সুযোগ থাকলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য তা অবরুদ্ধ (জহুরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নেতা, সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি, দৈনিক ডেল্টা টাইমস) এ মুহূর্তে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারিকরণের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অসঙ্গতি ও ক্ষোভ বেশি দিন পুঞ্জীভূত থাকলে বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষকদের মনে বঞ্চনা ও বৈষম্যের বেদনা থাকলে সুষ্ঠু পাঠদানও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেসরকারি শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের প্রতিকার করা না গেলে পুরো মাধ্যমিক শিক্ষা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/766106