৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:২১

একদফা বাস্তবায়নের পথে বিরোধী দল : রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা প্রবল

আসিফ আরসালান

অবশেষে বিএনপিকে নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে আওয়ামী লীগকেও তাদের আগের চাহিদা মোতাবেক বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে চরমোনাইয়ের পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন পেয়েছে কিনা সেটি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কোনো অনলাইন পত্রিকায় বা নিউজ পোর্টালে দেখলাম না। আগের দিন যখন বিএনপিকে নয়াপল্টন বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কোথাও দেওয়া হয়নি তখন ইসলামী আন্দোলন তাদের পূর্ব নির্ধারিত স্থান বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের পরিবর্তে হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে পূর্বমুখী যে গলি রয়েছে সেখানে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় যে বিএনপির মিত্রদল এবং জোট সমূহ যথা গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপি প্রভৃতি দল ও জোট যেখানে যেখানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, ধারণা করা হচ্ছে যে ঐ সমস্ত স্থান অপরিবর্তিত থাকবে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি ওয়ার্কিং ডে হওয়ার কারণে বিএনপিকে বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি না দেওয়া হয় তার সাথে সারাদেশব্যাপী বিশেষ করে ঢাকায় পাইকারি হারে গণ গ্রেফতারের কারণ কি? এমনকি বৃহস্পতিবার বেলা ৩ টা পর্যন্ত বিএনপি অফিসের সামনে ১০, ১৫ বা ১ শত নয়, কয়েক শত পুলিশকে সশস্ত্র অবস্থায় স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিল কেন? শুধু তাই নয়, পুলিশের সাথে জল কামান, রায়ট কার এবং আর্মারর্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার বা এপিসির মতো যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েনের প্রয়োজন হয়েছিল কেন? বিএনপির অফিসের সামনে কি বিএনপির নেতাকর্মীরা কোনো রকম উশৃঙ্খলতা করেছে? এমনকি তারা কি একটি পটকাও ফুটিয়েছে? ফোটায় নাই। তাহলে কেন পুলিশের এই যুদ্ধংদেহী ভাব? কেন কোনো কোনো পত্রিকার মতে ২৬ জুলাই দিনে এবং রাতে সহ¯্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলো?

আরো প্রশ্ন রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী জুলাইয়ের শেষ এবং ১লা আগস্ট ৩টি সমাবেশের অনুমতির জন্য সশরীরে পুলিশ অফিসে গিয়ে আবেদন করেছে। সেই আবেদনেরই বা রেজাল্ট কি? ইতোপূর্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সিলেট এবং চট্টগ্রামে জনসভা করার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। সুতরাং এবারও দেবে বলে মনে হয় না। আর যদি দেয় তাহলে সেটি হবে জামায়াতের জোর বরাত।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অনেক মাথা খাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে কেন বিএনপিকে ২৭ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি না দেওয়ার তো কোনোই কারণ দেখা যায় না। কারণ এই তো গত ২২ জুলাই বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের মহাসমাবেশ করতে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবার সমাবেশ ঘটেছিল। এর আগে একাধিক ওয়ার্কিং ডেতে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগকে সভা করতে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে তো কোনো দিন দেখা যায়নি কোনো অনুমতির প্রয়োজন। তাহলে এবার বিএনপির ক্ষেত্রে এটা করা হলো কেন?

এই নিয়ে যখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মাথা ঘামাচ্ছেন তখন ২৭ জুলাই ইংরেজি ডেইলি স্টার প্রথম পৃষ্ঠায় যে খবর প্রকাশ করেছে তারপর সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে। ২৭ জুলাই প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ডেইলি স্টারের ঐ খবরের শিরোনাম, BNP rally venue / Intelligence report behind police refusal / It hinted BNP might have been planning a sit-in. অর্থাৎ, বিএনপির মহাসমাবেশের স্থান / পুলিশের অনুমতি দানের অস্বীকৃতির পেছনে গোয়েন্দা রিপোর্ট / ঐ রিপোর্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে বিএনপি ঐ মহাসমাবেশের নামে সম্ভবত অবস্থান কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে।

॥ দুই ॥
রিপোর্টে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার পেছনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ঢাকা মহানগর পুলিশের কারণ ছিল একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক, মহাসমাবেশের নামে বিএনপি এই দুটি স্থানের যে কোনো একটিতে বসে পড়বে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত উঠবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দাবি আদায় না হয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ না করে। রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয় যে ঐ সিট-ইন বা অবস্থানের মাধ্যমে বিএনপি ঢাকা মহানগরীকে অচল করে দিতে চেয়েছিল। রিপোর্টে আরো বলা হয় যে বিএনপির শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছিল বলে তারা যেন ঢাকা আসার সময় পুরাতন বিছানার চাদর এবং সঙ্গে পরার মতো অতিরিক্ত কাপড় চোপড় নিয়ে আসেন। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ে এই বার্তা পাঠানো হয়েছিল। গত মঙ্গলবার অত্যন্ত উচ্চ পর্যায় থেকে ডেইলি স্টার এই খবরটি পায়। ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, তৃণমূল নেতাকর্মীদেরকে এই মর্মে বলা হয় যে পুলিশের তরফ থেকে দমন মূলক যত ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হোক না কেন, নেতাকর্মীরা যেন তাদের অবস্থান অর্থাৎ বসা অবস্থা থেকে উঠে না যান। এই রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে ঢাকা মহানগরী পুলিশ বিএনপিকে গোলাপবাগ মাাঠে সভা করার নির্দেশ দেয়। গোলাপবাগ মাঠে সভা করার নির্দেশ দেওয়ার সময় পুলিশের বিবেচনায় এই বিষয়টি ছিল যে গোলাপবাগ মাঠ শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত। তাই সেখানে বিএনপির সমাবেশে যদি কোনো অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে ঐ সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পুলিশের তেমন বেগ পেতে হবে না।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে গত বছরের ডিসেম্বর মাসেও বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার জন্য পুলিশের নিকট অনুমতি চায়। কিন্তু পুলিশ অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। তখন বিএনপি পুলিশের নির্দেশিত স্থান গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে। এই সিট-ইন এর ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) খন্দকার মহিউদ্দিনকে ডেইলি স্টার জিজ্ঞাসা করে। উত্তরে পুলিশের এই অফিসার বলেন যে, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। পুলিশ ২৬ জুলাই ইসলামী আন্দোলনকেও বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে সভা না করার জন্য বলে। পুলিশ তাদেরকে প্রথমে ইসলামী আন্দোলনের সভাটি স্থগিত করতে বলে। তখন ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়ামের সদস্য মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেন যে এই পর্যায়ে তাদের পক্ষে সমাবেশ মুলতবি করা সম্ভব নয়। তাদেরকে সভা করতেই হবে। তাই পুলিশের সিদ্ধান্তের পর তারা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে পূর্বমুখী রাস্তায় সভা করার সিদ্ধান্ত করে।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করার পরেও আমাদের বলতে হচ্ছে যে এই ধরনের রিপোর্ট তারা কোত্থেকে পেলেন? বিগত অক্টোবর মাস থেকে বিএনপি রাস্তায় আন্দোলন করছে। এরপর ৯ মাস হয়ে গেল। এই ৯ মাসে ৯ দিনও নয়, এমনকি ৯ ঘণ্টার জন্যও কি বিএনপি কোথাও কোনো উশৃঙ্খলতা বা অরাজকতা করেছে? একটি উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না। তাহলে এই ধরনের রিপোর্ট কেন?

॥ তিন ॥
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের এই ৫২ বছর পর্যন্ত রাজনীতির গতিপ্রকৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমন এক ব্যক্তি বলেন যে উশৃঙ্খলতা বা অরাজকতা বা নৈরাজ্য বিএনপি বা জামায়াত নয়, আসলে আওয়ামী লীগই সেটি চাচ্ছে। এটি এখন রাস্তার যে কোনো লোকও বলবেন যে যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগ ১০টি আসনও পাবে কিনা সন্দেহ। বিদেশীরা বিশেষ করে মার্কিনী এবং পশ্চিমাদের কাছে এই সরকার যতই ওয়াদা করুক না কেন, তাদের পক্ষে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ সেটি হলে তাদের তৎক্ষণাৎ ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। আর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা থেকে সরে যায় তাহলে শুরু হবে তাদের আমলনামা বিচার করার। তাহলে ঐ গ্রিক উপকথার মতো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে। বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং জেলা উপজেলার নেতারা কিভাবে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেন তার অনুপুঙ্খ হিসাব চাইবেন জনগণ। কিভাবে ৮ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দেশের বাইরে চলে গেল তার অনুপুঙ্খ তদন্ত হবে। বেগমপাড়ায় সাড়ে ৪ শতেরও বেশি প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক কারা এবং কিভাবে তারা এসবের মালিক হলেন সেগুলোও জানতে চাইবেন জনগণ। ৬ শতেরও বেশি মানুষের Enforced disappearance, অর্থাৎ গুম ও খুন হলেন, তার জন্য কে বা কারা দায়ী, সেগুলিও শনাক্ত হবে। আরো অনেক আমলনামা আছে যা মাত্র একটি কলামের সংক্ষিপ্ত পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

সুতরাং আওয়ামী লীগের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটি আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। তাদেরকে তাদের ইচ্ছা মতো ডিজাইন করা নির্বাচনই করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আরো স্যাংশন এবং ভিসা নীতির মতো আরো কঠোর অন্য কোনো নীতি আসতে পারে। ঐ দিকে আমেরিকা বলেছে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো রকম সহিংসতা চলবে না। তাই আওয়ামী লীগের বর্তমান এবং একমাত্র কাজ হলো কোনো না কোনো বড় সহিংসতা ঘটিয়ে তার দায় বিএনপি, জামায়াত এবং তাদের ৩৬ টি মিত্র দল ও জোটের ঘাড়ে চাপানো। কিন্তু এই বিষয়টি বিএনপি, জামায়াত এবং তাদের মিত্ররা অনেক আগেই বিলক্ষণ টের পেয়েছে। তাই তারা সরকারের কোনো রকম পাতা ফাঁদে তারা পা দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও দেবে না।

অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা করছেন যে নির্বাচন হতে এখনো ৫ মাস বাঁকি। এই ৫ মাসের মধ্যে যে কোনো সময় আওয়ামী সরকার নিজেই কোথাও না কোথাও একটি অঘটন ঘটাবে। আওয়ামী লীগের অতীত সাক্ষ্য দেয় যে আওয়ামী লীগ ঘটন অঘটন পটিয়সি। সুতরাং সাধু সাবধান।

এই লেখাটি শেষ করার পর গত ২৮ জুলাই শুক্রবার বিএনপির মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। নয়পল্টনের সমাবেশের এক প্রান্ত মধুমিতা, অপর প্রান্ত মালিবাগ এবং অপর প্রান্ত কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বিএনপি দাবি করেছে যে তাদের সমাবেশে ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। সংখ্যাটি যাই হোক, এই সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয় যে ২৯ জুলাই শনিবার ঢাকা মহানগরীর ৪টি প্রবেশ মুখে বিএনপির নেতাকর্মী এবং জনগণ বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত অবস্থান করবে। আওয়ামী লীগও পাল্টা অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এরমধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ঘোষণা করেছেন যে কাউকেই রাস্তা অবরোধ করতে দেওয়া হবে না। রাস্তা অবরোধ করলে পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এরফলে সংঘাত সৃষ্টি হবে বলে সব মহল আশঙ্কা করছেন। আজকের লেখাটি শনিবার সকালেই সাবমিট করতে হবে বলে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির সর্বশেষ পরিস্থিতি পাঠক ভাইদেরকে জানানো সম্ভব হলো না। আগামী রবিবারের কলামে সর্বশেষ রাজনীতি এবং সংঘাতের পরিস্থিতি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রইলো।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.info/post/531303