৩১ জুলাই ২০২৩, সোমবার, ১১:১৬

পুলিশ দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ

রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য তথা কাক্সিক্ষত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে হয় রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবেই। এটি বৈশ্বিক রাজনীতির ঐহিত্যও। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে সে অবস্থার বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটতে শুরু করেছে। ফলে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিপক্ষের ওপর বল প্রয়োগের মাধ্যমে। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাকেলা করার চেষ্টা করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে; রাষ্ট্রীয় শক্তির অপব্যবহার করে। অথচ একথা আমরা সকলেই অবগত আছি যে, আমাদের দেশে যে রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে তা আইনশৃঙ্খলা জনিত নয় বরং সঙ্কটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। তাই এর সমাধান রাজনৈতিকভাবে এবং আলোচনার টেবিলে হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে সে সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে জাতি হিসাবে আমরা ক্রমেই পশ্চাদপদ হচ্ছি। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা নিজেদেরকে প্রস্তুতও করতে পারছি না।

আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা স্বাধীনতার ৫ দশক পরও কোন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারিনি। যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারাই নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করেন-এটা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে রীতিমত ট্রাডিশন হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার দাবি দীর্ঘ দিনেরই। আমাদের দেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তা আমাদের দেশের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এ জন্য আমাদেরকে চড়া মূল্যও দিতে হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতায় সংবিধানে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই পদ্ধতি বাতিলে অজুহাত ও ছলছুতার কোন অভাব হয়নি। দাবি করা হয়েছে যে, কেয়াটেকার সরকার নাকি গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু এখন তো প্রশ্ন করা যেতেই পারে, দিনের ভোট রাতে করা ও ব্যাপক ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ রয়েছে তা কি গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ? উত্তরটা রীতিমত নেতিবাচকই হওয়ার কথা।

আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। কখনো সূক্ষ্ম কারচুপি, আবার কখনো স্থূল কারচুপির সাথেও আমরা পরিচিত হয়েছি। আর রাজনীতিকদের এমন উপর্যুপরি ব্যর্থতার কারণেই আমাদের দেশে এক অভিনব নির্বাচকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির আবশ্যকতা অনুভূত হয়েছে। এটি আমাদের দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতাও। কিন্তু এর মাধ্যমে আমাদের জাতি হিসাবে আমাদের সম্মান বৃদ্ধি পায়নি। কারণ, আমাদের রাজনীতিবিদরা আমাদেরকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে নির্বাচনকালীন অরাজনৈতিক সরকারের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। জাতি হিসাবে এর চেয়ে অসন্মানের কথা আর কী-ই বা হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন উপলব্ধি আছে বলে মনে হয় না।

দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না সে অভিযোগেই নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে রাজপথ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনায় এই দাবির যৌক্তিকতাও সাধারণ মানুষের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে কর্মসূচি পালন করছে। বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও সরকার বিষয়টির রাজনৈতিক সমাধানের দিকে না গিয়ে বরং বিষয়টিকে আইনশৃঙ্খলার সাথে সম্পৃক্ত করে বিরোধীদলীয় কর্মসূচিতে পুলিশ লেলিয়ে ডা-া মেরে ঠা-া করার নীতি গ্রহণ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা উচিত বিষয়টি রাজনৈতিক; আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক নয়। আর পুলিশ দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর ফলও ইতিবাচক হয় না।

তাই বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে হওয়া উচিত। পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা গণতান্ত্রিক চেতনা নয় বরং স্বৈরতান্ত্রিকতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তাই বাস্তবতা উপলদ্ধি করে চলমান সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান করা উচিত। অন্তত এমন কোন পদ্ধতি আবিষ্কার ও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত যাতে ভোটারদের মধ্যে কোন অস্বস্তি বা অভিযোগ না থাকে। আর পুলিশ দিয়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ হবে আত্মঘাতী!

https://dailysangram.info/post/531301