২৯ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ৮:৪২

পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এলেও ডেঙ্গু হতে পারে

ডেঙ্গু শনাক্তে রক্তের পরীক্ষা তিনটি। প্রথমটি এনএস১। সাধারণত এটি পজিটিভ হলেই ধরা হয় রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এ বছর এর ব্যত্যয় ঘটেছে।

দেখা গেছে, এনএস১ নেগেটিভ হলেও অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। পরে অন্য দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা প্রথম পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলে অন্য দুটি পরীক্ষা আইজিএম ও আইজিজি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল শুক্রবার ডেঙ্গুতে চারজনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৫০৩ জনের হাসপাতালে ভর্তির তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ছুটির দিন থাকায় গতকাল ঢাকার ২৫টি হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ হাসপাতাল কোনো তথ্য দেয়নি।
নতুন রোগীদের নিয়ে এ বছর রোগী হয়েছে ৪৪ হাজার ২০৫ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ২২৯ জন। ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ২৮১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে আট হাজার ৬৭৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় চার হাজার ৮৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে তিন হাজার ৮০৬ জন ভর্তি রয়েছে।
এ বছর এডিস মশা শনাক্তে চালানো জরিপে ঢাকায় মশার যে উপস্থিতি দেখা গেছে, এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
ডেঙ্গু শনাক্তকরণে দ্বিধা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘এবার আমরা অনেক রোগী পেয়েছি, যাদের ডেঙ্গুর উপসর্গ রয়েছে, কিন্তু এনএস১ নেগেটিভ।
অথবা আইজিজি, আইজিএম পজিটিভ নয়। আমাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এনএস১ ও আইজিএম পজিটিভ না হলে রোগীর ডেঙ্গু হয়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় দিন ডেঙ্গু নেগেটিভ হচ্ছে, তৃতীয় দিন পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। এরপর আবার নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে। আবার আইজিএম পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রথম তিন দিন আইজিএম নেগেটিভ, চতুর্থ দিন থেকে শুরু হয়ে সেটি ১৪-১৫ দিন পজিটিভ থাকতে পারে। অর্থাৎ ডেঙ্গু এনএস১ নেগেটিভ হলেই যে ডেঙ্গু হয়নি, তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘আগে ডেঙ্গুর ইনফেকশন জানা যায় আইজিজি পরীক্ষার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, প্রথমে নেগেটিভ আসছে, পরে আবার ছোট অংশ পজিটিভ আসছে। অর্থাৎ আমাদের যে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এনএস১ পজিটিভ না হওয়া মানে ডেঙ্গু নয়। এটির কিন্তু ব্যত্যয় ঘটছে। এনএস১ পরীক্ষার ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সেরোটাইপ ২ ও ৪ বেশি ফলস নেগেটিভ আসছে। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের এনএস১ পরীক্ষা কম সেনসিটিভ।’
ডেঙ্গুর পরীক্ষা কখন করাবেন

ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রোটিন এনএস১ দ্বারা ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়। জ্বর হওয়ার প্রথম দিন থেকেই ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা যায়। তবে চতুর্থ বা পঞ্চম দিন থেকে এটি আবার নেগেটিভ হয়ে যায়। তাই জ্বর যদি চার-পাঁচ দিনের বেশি থাকে, তাহলে এই পরীক্ষা করে লাভ নেই। সে ক্ষেত্রে ডেঙ্গু আইজিএম অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যায়। এ সময় এটি পজিটিভ আসবে। আবার ৯-১০ দিনের মাথায় এটিও নেগেটিভ আসে। তখন আইজিজি অ্যান্টিবডি পজিটিভ দেখায়। চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুর উপসর্গ থাকলে প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো পরীক্ষা করা উচিত নয়।
৫ শতাংশের সিভিয়ার ডেঙ্গু

অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, একটা মশা যদি চারজনকে কামড়ায়, এদের মধ্যে তিনজনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অর্থাৎ ৭৫ শতাংশের উপসর্গ থাকে না। যাদের উপসর্গ দেখা দেয়, তাদের মধ্যে ৫ শতাংশের সিভিয়ার ডেঙ্গু হয় এবং বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন—রক্তপাত হওয়া, পেটে পানি জমে যাওয়া। সেখান থেকে রোগী শকে চলে যায়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু সাধারণত একটি স্বসীমিত রোগ। এটি নিজে নিজে ভালো হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম, যখন প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত শনাক্ত হবে এবং যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাবে। যদি কেউ দেরিতে হাসপাতালে আসে এবং সিভিয়ার রোগী নিয়ে আসে, সে ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ৫ শতাংশ। আর যদি চিকিৎসা না দেওয়া যায়, মৃত্যুহার বেড়ে ২০ শতাংশ হতে পারে।
আগস্ট-সেপ্টেম্বর নিয়ে শঙ্কা

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার মে মাসের বৃষ্টিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। জুন-জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। আগামী দুই মাস বৃষ্টির সময়। এ ছাড়া তাপমাত্রা ও আবহাওয়া মিলিয়ে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার।’

কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর ডেঙ্গু শুধু যে ঢাকায় রয়েছে, তা নয়। ঢাকার বাইরেও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘এবার গবেষণায় আমরা ৪৩ শতাংশ মশা পেয়েছি বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনে। আমরা দেখেছি, মাল্টিপারপাস ভবনের যেখানে গাড়ি ধোয়া হয়, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন ও বাসিন্দারা যায় না। ফলে সেখানে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে। এ মশার জন্য বৃষ্টির কোনো প্রয়োজন নেই। শীত, বর্ষা সব সময় গাড়ি ধোয়ার জন্য পানি ব্যবহার করা হচ্ছে আর এডিস মশা জন্মাচ্ছে।’


https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/29/1303340