২৯ জুলাই ২০২৩, শনিবার, ৮:৪১

ভূমধ্যসাগরে প্রতিবছর ৫০০ বাংলাদেশির মৃত্যু

দালালের মাধ্যমে ইউরোপ যাচ্ছিলেন আব্দুল নবি (৩০)। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের বড়চর গ্রামে তাঁর বাড়ি। পরিবারের কাছে সর্বশেষ তথ্য ছিল, গত মার্চ মাসে তিনি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই।

সে সময় নবির সঙ্গে আরো ৯ জন যুবক নিখোঁজ হন। দুই মাস পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নবির পরিবারকে জানানো হয়, গত জুনে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে তিনি মারা গেছেন।
নবির বড় ভাই মাহাআলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দালাল তাকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখান থেকে ইতালি পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশে নবি নৌকায় ওঠে।
সেটাই তার শেষ যাত্রা।’

আরেক ভুক্তভোগী সিরাজুল ইসলামের (৩৩) বাড়ি মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার বনগ্রামে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দালাল তাঁকে ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। আট মাস পর অক্টোবরে দুই শতাধিক যাত্রীর সঙ্গে একটি নৌযানে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন সিরাজুল।

তিউনিশিয়ার উপকূলে গিয়ে এটি ডুবে যায়। সাঁতরে তীরে উঠে প্রাণে রক্ষা পান সিরাজুল। তিউনিশিয়ায় দুই মাস থাকার পর এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় ডিসেম্বরে দেশে ফেরেন তিনি।
এ ধরনের নৌযানডুবির খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসছে। এর পরও ইউরোপে নেওয়ার নামে ঝুঁকিপূর্ণ এই অবৈধ মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্য মতে, অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়। প্রথম স্থানে রয়েছে তিউনিশিয়া, দ্বিতীয় মিসর। প্রতিবছর অবৈধভাবে এই সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে গড়ে নৌকাডুবিতে ৫০০ বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটে। অনিশ্চিত এই যাত্রার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে তারা।
এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল ৩০ জুলাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘রিচ এভরি ভিক্টিম অব ট্রাফিকিং, লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’।

ব্র্যাকের তথ্য মতে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ২৯ হাজার ৭৭৮ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ওই সাগর পাড়ি দিয়েছে ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৯৪ জন বাংলাদেশি।
অভিবাসন কর্মসূচি থেকে জানানো হয়, গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা দুই হাজার ২৮৪ জনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি লোক ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এ ব্যাপারে তিন লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন একেকজন।
১৮ পথে ইউরোপযাত্রা

ব্র্যাক জানায়, বাংলাদেশ থেকে ১৮টি পথ ব্যবহার করে মানবপাচারের চেষ্টা চলে ইউরোপে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভূমধ্যসাগর, যা সেন্ট্রাল মেডিটেরানিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। এই যাত্রা শুরু হয় মূলত লিবিয়া থেকে। গত বছরে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইতালিতে অনুপ্রবেশকারীদের ৬৫ শতাংশই লিবিয়া থেকে এসেছে। সেখান থেকে ইতালি ও মাল্টায় অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশি।
পাচারের প্রচার হয় সামাজিক মাধ্যমে

ইউরোপের দেশে যেতে আগ্রহীদের আকৃষ্ট করতে অন্যতম প্রচারমাধ্যম হলো ফেসবুক, টিকটক, লাইকি ও হোয়াটসঅ্যাপ। বড় জাহাজের কথা বলা হলেও ওঠানো হয় সাধারণ নৌকা বা রাবারের তৈরি উদ্ধারকারী বোটে। শুরু হয় অনিশ্চিত যাত্রা।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দেখছি যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়তে চলে আসছে। যেখানে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে অবস্থান করছি, সেখানে এটা কোনোভাবেই সম্মানজনক নয়। ফলে এটা বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, যারা এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে, তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যে তারা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে।’
সরকার সব ধরনের অবৈধ অভিবাসনকে নিরুৎসাহ করছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় চেষ্টা করি, কেউ যাতে অবৈধ পথে সাগর পাড়ি না দেয়। এ ব্যাপারে সরকার সব সময় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সব ধরনের অবৈধ ও অনিয়মতান্ত্রিক অভিবাসনকে সব সময় নিরুৎসাহ করে আসছে সরকার। পাশাপাশি আমাদের শ্রমকল্যাণ শাখার মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতেও কাজ করে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/29/1303339