২৮ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:২১

দফার দ্বন্দ্ব ও ছন্দহীন রাজনীতি

-ইয়াসিন মাহমুদ

নির্বাচন আসলেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজপথ। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব নীতি ও আদর্শের পক্ষে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এ যেন তুমুল যুদ্ধ। রাজপথের মতোই মঞ্চেও চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। জনগণই কেবল দর্শক তা নয় দেশের কথিত বুদ্ধিজীবী মহলও এ খেলা দেখতে অভ্যস্ত। এ যুদ্ধের কি আদৌ সমাধান নেই সে প্রশ্ন আজ সবখানে। দেশে এখন প্রধান ইস্যু আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। একপক্ষ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না; যেকোন মূল্যে ক্ষমতা আমার পাওয়া চাই। অন্যপক্ষ ক্ষমতাসীনদেরকে অযোগ্য ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়। বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলের ভেতর এই দ্বন্দ্ব আজ প্রকট হয়ে ওঠেছে। দফার খেলা দফার দ্বন্দ্ব। দু’দলের দফা একটাই। সবাই নিজেকে বাঘ-সিংহর বনে নিয়ে গেছে। উভয় দলের অবস্থান এখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। গত ১২ জুলাই ২০২৩ ঢাকায় দু’দলই সমাবেশের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরÑদক্ষিণ আয়োজিত শান্তি সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেনÑবিএনপির একদফা হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আমাদেরও এক দফা, শেখ হাসিনা ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই হবে, শেখ হাসিনাই নেতৃত্ব দেবেন।

অপরদিকে, রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আয়োজিত সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ চেয়ে ‘এক দফা, এক দাবি ’ ঘোষণা করেন। ‘একদফা, একদাবি’ সম্পর্কে তিনি বলেনÑবাংলাদেশের জনগণের ভোটারাধিকার হরণকারী বর্তমান কর্তৃত্ববাদী অবৈধ সরকারের পদত্যাগ চায়; এটাই একদফা, একদাবি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আরো বলেনÑএরপরও যদি আঙুলে ঘি না ওঠে, তাহলে কী করে ওঠাতে হয়, এদেশের মানুষ জানে। প্রয়োজনে প্রত্যাশিত কর্মসূচি নিয়ে এই কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সরিয়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো। যদি কোথাও ফয়সালা না হয়, ফয়সালা হবে রাজপথে। এই সমাবেশে দলটির আরো অনেক জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তব্য দেন। তাদের দু’একটি বক্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন বোধ করছি। বিএনপি নেতা আমীর খসরু চৌধুরী বলেনÑবিদেশীরা তো ভারতে, নেপালে, ভুটানে, শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছে না। বাংলাদেশে কেন আসছে, সেটা সবার কাছে পরিষ্কার। তিনি আরো বলেনÑ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন হতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণ জেগেছে, আপনাদের যেতে হবে।’

ক্ষমতাসীন ও বিরোধী পক্ষ উভয়ই নিজ অবস্থানে একাট্টা। চলছে তাদের কর্মসূচি। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি আরো বেশি ঘোলাটে হচ্ছে। দু’দলই ক্ষমতার লড়াইয়ে মাঠে নেমেছে। রীতিমতো খেলা চলছে। হার-জিত বুঝতে আরো ঢের সময়ের প্রয়োজন। তবে এরই মধ্যে জনগণের নাভিশ^াস উঠেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তেল, কয়লা, গ্যাস এবং বিদ্যুতের চরম ঘাটতিসহ দেশ নানা সংকটের মধ্যে টলটলায়মান। তবে সেদিকে খেয়াল করার সময় এখন নেই সরকারের। নেই কোন মাথাব্যথা। কোনোরকম সময় পার করা। নিজস্ব পলিসি মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিরোধী দলগুলোর চাপ, পাশাপাশি বিদেশী নানা দেশ ও সংস্থার বহুমুখী চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সরকারের। এই মুহূর্তে জনগণ নিয়ে ভাবনার সময় খুবই কম। জনগণের জন্য সরকার একটিই বার্তা দেবার চেষ্টা করছে-আওয়ামী সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে তাই এই সরকার বারবার দরকার। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো জনগণকে বলার চেষ্টা করছে, আওয়ামী লীগ সরকার জালিম সরকার। মানুষের প্রতি অনেক জুলুম-নির্যাতন করেছে। হামলা- মামলায় জর্জরিত জনজীবন। সবখানে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি। এ সরকারকেই সবাই মিলে লালকার্ড দেখাতে হবে। বিদায় ঘোষণা করতে হবে।

উভয় দল এখন রাজনীতির মাঠে সরব। চারিদিকে শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচি। সমাবেশ, মিছিল, মিটিং। একদল এই কর্মসূচিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবার দাবি করছে। অন্যপক্ষ গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটারাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বলে দাবি করছে। উভয় দলই জনগণের কল্যাণকামী। হিতাকাক্সক্ষী ও শুভানুধ্যায়ী। এখন প্রশ্ন, জনগণ কার খালু?

গত ১৩ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোর ৩ নং পৃষ্ঠায় ৩টি ছবি ছাপা হয়। ছবি ৩টির ক্যাপশন উল্লেখ করতে চাই। ১. ঢাকাÑআরিচা মহাসড়কে বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশিচৌকি। ঢাকাগামী বিভিন্ন গণপরিবহন, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে চলছে তল্লাশি। তানভীর আহাম্মেদ এর ক্যামেরায় ছবিটি ছিল সাভারের আমিনবাজার এলাকার। ২. গণপরিবহন না পেয়ে হাঁটছে পরিবার। ছবিটি ছিলো গাবতলী এলাকার। ৩. পুলিশি তল্লাশির সময় বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের। তাই হেঁটেই গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন। এ ছবিটি সাভারের আমিনবাজার এলাকায়।

এ ছবিগুলোর বার্তা হলো-সভা, সমাবেশ মানেই জনদুর্ভোগ। ভোগান্তি ও হয়রানি। তাহলে জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টা আমরা কেউই ভাবছি না আপাতত। মুক্তি কোথায়? মুক্তির পথ কি একবারেই রুদ্ধ? আমাদের মনে হয় সকল রাজনৈতিক দলকে জনগণের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। সমঝোতায় আসতে হবে। একটি স্থিতিশীল পরিবেশ কেবলই জনগণের প্রত্যাশা। স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি চায় তারা। একটি সংঘাতমুক্ত সুষ্ঠু ভোটের ঘোষণা কমিয়ে আনতে পারে অস্থিরতার ব্যারোমিটার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, ইইউ এর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের নেতৃবৃন্দের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। তাদেরও একটাই প্রত্যাশা-বাংলাদেশে এবার একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ফিরে আসবে।

জনগণ তাদের পছন্দের ব্যক্তিদেরকে ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের ছক আঁকছে। বিএনপিসহ তার শরীকরা চায় নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকাররের অধীনে সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নানা পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ মনে করছেন-দ্বাদশ নির্বাচনটি খুব সহসা হবে না। সরকারের জন্যও একটা চ্যালেঞ্জ। খুব সহজে পার পাওয়া যাবে না। তবে সহজ ও কঠিনের বিষয়টা অনেকটা নির্ভর করবে বিএনপির উপর। তারা যদি তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ’র মতো কারো খপ্পরে পড়ে অসমতল নির্বাচনী মাঠে খেলতে নামে তাহলে ২০১৮ সালের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে তাদের। গতবার জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দল বানিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন কতটুকু প্রতিযোগিতামূলক হবে তা বলা মুশকিল।

https://dailysangram.info/post/531108