২৮ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:১৯

শুরু হয়ে গেছে পুরোনো খেল্

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার যে খেল্ দেখিয়েছিল সেটার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনে ভোট কেটে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে তারা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করেছিল। এ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম চমক। সে নির্বাচনে বিরোধীদল তথা বিএনপি অংশ নেয়নি। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল নির্বাচনে কেউ অংশ না নিলে আমরা কি তাদের হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে নিয়ে আসব? কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেয়ার মতো কোনো পরিবেশ সেখানে ছিল না। নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের ওপর হামলা, মামলা, গায়েবি মামলা, খুন-খারাবি- এমন কোনো পথ নেই যা আওয়ামী লীগ অনুসরণ করেনি। তখন থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনে গায়েবি মামলা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে থাকে।

গায়েবি মামলা হলো এমন এক ধরনের মামলা, যে ঘটনা ঘটেইনি সে রকম ঘটনা ঘটেছে দেখিয়ে বিরোধীদলের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়। বলা হয়, অমুক জায়গায় বিএনপির লোকেরা ককটেল মেরেছে। সেখানে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ককটেল মারার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মামলাগুলো দায়ের করেছে প্রধানত পুলিশ। আশপাশের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
আবার এমনও হয়েছে যে, হাঙ্গামা বাঁধিয়েছে পুলিশ বা সরকারি দলের লোকেরা। তাতে অনেকেই আহত হয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই বিএনপি দলীয় সদস্য। কিন্তু পুলিশ যখন মামলা করেছে তখন আহত বিরোধীদলের সদস্যদেরকেই আসামী করা হয়েছে। পুলিশ বা সরকারি দলের লোকেরা কোথাও আগুন দিয়ে বলেছে এটা বিরোধীদলের কাজ। এর কোনো প্রমাণ তারা কখনোই হাজির করতে পারেনি। বরং দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বিরোধীদলের সদস্যদের। এটা শুধু থানা-পুলিশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এসব মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছিল বিনা প্রমাণে মাসের পর মাস কখনো কখনো বছরের পর বছর তাদের জেল খাটতে হয়েছে বা হচ্ছে। এসব রায় দিয়েছে নিম্ন আদালত। উচ্চ আদালতে গিয়েও তার খুব একটা প্রতিকার পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশ মিলে কোথাও আগুন দিয়েছে। কিন্তু অপরাধী করা হয়েছে ঐ বিএনপি সদস্যদেরকে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এমনই এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত ঐ সব ঘটনার জন্য বিএনপিকেই দায়ী করছে। যদিও অনেক প্রমাণ আছে যে, আওয়ামী লীগই সারাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। আওয়ামী লীগ এর সবচাইতে বড় উদাহরণ টানে হোটেল শেরাটনের সামনে বিএনপি নাকি বাসে আগুন দিয়ে ১৪ জন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ঘটনা ঘটিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা পঙ্কজ দেবনাথ। তার দলের জেলা সভাপতি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য পঙ্কজ এই কাজ করেছিলেন।

তারপর তথাকথিত একটি নির্বাচন হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হলো, এই নির্বাচন শুধু নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে নতুন নির্বাচন দেয়া হবে। কিন্তু সে অবস্থা কোনো দিন আসেনি। বরং বিরোধীদলের ওপর নিপীড়ন বাড়তেই থেকেছে। এই তথাকথিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কাছাখোলা সমর্থন দিয়েছিল ভারত। ভারত তার স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করতে চেয়েছিল। তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়।

গায়েবি মামলার প্রশ্ন আসতে আসতে পিছনে পড়তে থাকে। এর ফাঁক দিয়ে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী অনেক কিছুই আদায় করে নেয়। তারা তিস্তার পানি বণ্টনের নামে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষকে চরম ধোঁকা দিতে থাকে। উপরন্তু ট্র্যানজিট-করিডোর সবকিছু একটা নতজানু সেবাদাস সরকারের কাছ থেকে হস্তগত করে। এর জন্য আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি অনুযায়ী যে ফি দেয়ার কথা ভারত সেটা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। সরকারের একজন উপদেষ্টা তো বলেই বসেন যে, ট্র্যানজিট-করিডোরের ফি চাওয়া হবে চরম অসভ্যতা। ঐ ভদ্রলোক যে কোন্ দেশের নাগরিক সেটি বুঝে ওঠা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে।

তিস্তার পানি বণ্টনের, না অবাধে ট্র্যানজিট-করিডোর, বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার, কোনো ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তেমনিভাবে সারা বাংলাদেশের সড়ক-নৌ-রেলপথ অবাধে ব্যবহার করতে শুরু করে ভারত। কখনও কখনও এমন মনে হয় যে, বাংলাদেশ কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কিনা? নাকি এটি ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে? বিরোধীদলের ওপর এই নির্যাতন নিপীড়ন, গুম, খুন, চালিয়ে সরকার তার ক্ষমতা সংহত করতে চেয়েছে। আর বাংলাদেশের স্বার্থ ভারতের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে।

এরপর আসে ২০১৮ সালের নির্বাচন। সে নির্বাচনে শিখ-ি হিসেবে আসেন ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগ বহু আগে তাকে দল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে। কিন্তু তিনি এসে হাজির হন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আলোচনায় বসেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে আলোচনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। বরং বিএনপিকে নির্বাচনে এনে বিএনপির ইজ্জত ডুবিয়ে দিয়েছিলেন কামাল হোসেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকেই তা পত্রিকায় প্রচার করা হয়। তাতে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। যার কোনোটাই তিনি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেননি। বরং আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা কে কোন আইটেম খেতে পছন্দ করেছিলেন সেগুলোই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এই তামাশার আয়োজন করে কামাল হোসেন একেবারে চিরতরে ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হন। তারপর আস্তে আস্তে ইতিহাস থেকে মুছে যায় ড. কামাল হোসেনের নাম। তিনি সুস্থ আছেন না অসুস্থ, সক্রিয় না নিষ্ক্রিয়- এ খবরও এখন আর কেউ রাখে না।

২০১৪ নির্বাচন। সে এক মহা জালিয়াতির নির্বাচন। জালিয়াতি যে হবে সেটা টের পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের বি-টিম বলে নিন্দিত জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও। তিনি বেঁকে বসলেন এই নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। তিনি যাদের প্রার্থী করেছিলেন, তাদের সকলের প্রার্থিতাপত্র প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু মেরুদ-হীন সরকারের সেবাদাস নির্বাচন কমিশন সে প্রত্যাহার পত্র গ্রহণ করেনি। এরশাদ তখন কয়েকদিনের জন্য আত্মগোপন করেন। শেষ পর্যন্ত তাকে আবিষ্কার করা হয় সিএমএইচ-এ। সেখানে সরকারের সঙ্গে তার একটা দহরম মহরম হয়। বিএনপিসহ সকল বিরোধীদল আগেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছিল সম্পূর্ণ একতরফা। তখন ভারত শেখ হাসিনার সরকারকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসে। এরশাদকে নির্বাচনে রাজি করানোর জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সুজাতা সিং এরশাদকে বলেন যে, আপনি নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে যাবে। এরশাদ সুজাতাকে বলেছিলেন, তার জন্য আমি দায়ী নই। দায়ী সরকার। শেষ পর্যন্ত রফা হয় এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োজিত হবেন। শেষ পর্যন্ত হয়েছিলও তাই।

ঐ নির্বাচন জনগণ করেনি। বা জনগণের ভোটেও হয়নি। ঐ নির্বাচন হয়েছিল পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা। তারা আগের রাতেই ব্যালট বাক্সগুলো ভরে রেখেছিল। তার ছবি প্রকাশ করেছিল বিবিসি। সরকারের তরফ থেকে বলার চেষ্টা করা হয় যে, এই ব্যালট বাক্সগুলো আগের। নির্বাচন যথাযথভাবেই হয়েছে। নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মাত্র সাতটি আসনে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এই নির্লজ্জ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সারা বিশ্বে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে যায়। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর জোর দিতে থাকে। জাপানের রাষ্ট্রদূত তো বলেই ফেলেছেন যে, নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয় এ কথা তিনি পৃথিবীর কোথাও শোনেননি।

দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন ডিসেম্বরের শেষে অথবা জানুয়ারির শুরুতে হওয়ার কথা। কিন্তু এর মধ্যেই শুরু হয়েছে মামলা, হামলা ও গায়েবি মামলার হিড়িক। গত ২২ জুলাই সে রকম একগুচ্ছ গায়েবি মামলার হিসাব প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। সেখানে অনেক উদাহরণ আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড-এর আওয়ামী লীগ নেতা খয়েরউদ্দিন আহমদের করা মামলার বিবরণ ছিল এরকম- পুরান ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা সূত্রাপুরের বানিয়ানগর মোড়। এই মোড়ে ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পৌনে ছ’টার দিকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০-২৫ নেতা কর্মী সরকার বিরোধী শ্লোগান দিতে শুরু করে। সরকার বিরোধী শ্লোগান দিতে নিষেধ করলে তারা অতর্কিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ওপর হামলা চালান। পরে হত্যার উদ্দেশ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। কিন্তু ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে কেউ এমন ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন সেটা বলতে পারেননি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ ও ২টি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করেছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। মামলার বাদী ইট পাটকেল ছুঁড়েছে বলে দাবী করলেও কোনো ককটেল হামলা হয়নি বলে জানান।

এ রকম হামলার অভিযোগ এনে গত ৭ মাসে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কেবল আওয়ামী লীগের নেতারা বাদী হয়ে ৪০টি মামলা করেছেন। তাতে আসামী হিসেবে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ১৭০১ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামীর সংখ্যা আরও ২৫৭৫ জন। বিএনপি নেতাদের দাবী এ সবই গায়েবি মামলা। অর্থাৎ ঘটনা ঘটেনি। তারপরেও মামলা করা হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরে গত মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে গত শুক্রবার (২১ জুলাই) আরও দুটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে পদযাত্রা ঘিরে ৩ দিনে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়ালো ১৯। আর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৩৬৩ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামী ৭৩৫১ জন। এসব মামলার বাদী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর সবই পুরোনো কৌশল। অর্থাৎ নির্বাচন যখন হবে, তখন অজ্ঞাতনামা আসামীদেরও দৌড়ের ওপর রাখা হবে। এবং যে কোনো অভিযোগে গ্রেফতার করে নির্বাচনী পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে নেবার চেষ্টা করবে সরকার।
কিন্তু এবার বিষয়টি তত সহজ বলে মনে হয় না। সারা বিশ্ব এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ সরকারকে বার বার সতর্ক করছে যে, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার দিতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেয়া যাবে না। এত কিছু অতিক্রম করে সরকারের পক্ষে এবারও একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

https://dailysangram.info/post/531107