২৬ জুন ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৭

হাটে দামের চাপে ক্রেতা, অস্বস্তিতে খামারি

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ব্যাপারী আজিজুর রহমান রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলার হাটে তুলেছেন ১৫টি দেশি গরু। তাঁর সাফ কথা, সব ধরনের পশুর খাদ্যের দাম চড়া, বেড়েছে গাড়ি ভাড়া। লাখের নিচে একটি গরুও বেচবেন না এবার। কুষ্টিয়ার রহমত উল্যাহ ছোট-বড় ৫৫টি গরু নিয়ে দাঁড়িয়েছেন একই হাটে। তাঁর ভাষ্য, ক্রেতাদের দেখে মনে হচ্ছে চরম টানাটানিতে আছেন। বাজারের সবচেয়ে ছোট ও কম দামি গরু খুঁজছেন অনেকে। এদিকে গাবতলী হাটে ১১টি বড় গরু নিয়ে এসেছেন নাটোরের খামারি মোসলেম উদ্দিন। তিনি বলেন, ঢাকায় গরু এনে হতাশ। বাজার নানা জাতের পশুতে ভরপুর, তবে ক্রেতা নেই। মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ। যে কয়জন ক্রেতা আসছেন, তাঁদের চোখ ছোট গরুর দিকে।

ঢাকার বাইরে থেকে পশু নিয়ে আসা এসব খামারি ও ব্যাপারীর হাপিত্যেশই বলে দিচ্ছে, এবার ব্যবসা নিয়ে বেশ অস্বস্তিতেই আছেন তাঁরা। উচ্চমূল্যের বাজারে চিড়েচ্যাপ্টা ক্রেতারাও ভালো নেই। রাজধানীতে ট্রাকে ট্রাকে ঢুকছে কোরবানির পশু। তবে হাটে নেই তেমন ক্রেতা, এখনও জমেনি কেনাবেচা।

এবার ছোট গরুর চাহিদা বেশি। ছোট, মাঝারি কিংবা বড়– যে আকারেরই হোক না কেন, সব ধরনের গরুর দাম বেশি। এমন অবস্থায় অর্থনৈতিক মন্দায় সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে। ফলে এ বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত বিপুলসংখ্যক গরু-ছাগল অবিক্রীত থাকার শঙ্কা রয়েছে। আর আগের কয়েক বছরের মতো এবারও অবিক্রীত পশু নিয়ে বিপদে পড়তে পারেন খামারি ও ব্যাপারীরা। এদিকে বর্ষা মৌসুমের আগেই গবাদি পশুর শরীরে দেখা দিয়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি)। কোরবানির ঈদের আগে এমন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় খামারিদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

সব মিলিয়ে কোরবানি ঈদের আগে ক্রেতারা যেমন অস্বস্তিতে আছেন; আবার দাম কেমন হবে, কতটা লাভ করতে পারবেন তা নিয়ে বিক্রেতাদের মাঝেও রয়েছে দুশ্চিন্তা। তবে জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়ায় অন্যবারের তুলনায় এবার পশু বিক্রি কিছুটা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মজুত বেশি, দামও বেশি
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর কোরবানিযোগ্য মোট গবাদি পশুর সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি, যা গেল বছরের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪৪টি বেশি। এ বছর কোরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। সে হিসাবে এ বছর কোরবানির পরও দেশে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি পশু থেকে যাবে। এত মজুত থাকার পরও কোরবানির পশুর দাম যে বেশ খানিকটা বাড়বে, সেটার আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও খামার ঘুরে পশুর বাড়তি দামই দেখা গেছে। মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রোতে গভীর রাত পর্যন্ত থাকছে ক্রেতাদের ভিড়বাট্টা। গরু, উট, দুম্বা, গোলাপি মহিষ, ভেড়া ও খাসি বিক্রি চলছে দেদার। ঈদ উপলক্ষে আকর্ষণীয় নানা গরুর সমাহার এখানে। মিলছে ১ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার পশু। প্রস্তুত করা সাড়ে ৮ হাজার পশুর মধ্যে ৭০ শতাংশ বিক্রি হয়ে গেছে। সাদিক এগ্রোর কর্মকর্তা শাহ ইমরান বলেন, যে গরুর দাম গত বছর ছিল ৭০ হাজার টাকা, এবার তা ১ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবার লাইভ ওজন প্রতি কেজি ৪৬০ থেকে ৪৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। এবার প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাদের খামারে উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। ছোট গরুর চাহিদা বেশি, এ কারণে এগুলোর দামও এবার বাড়তি। তবে বড় আকারের গরুর দাম আগের মতোই থাকতে পারে।

রাজধানীর গাবতলী হাট ঘুরে দেখা গেছে, তিন মণ মাংস মিলবে এমন গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৯৬ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। আর চার মণ মাংস মিলবে এমন একটি দেশি মাঝারি গরুর দাম ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে। ফলে দেখা গেছে, গত বছর থেকে এবার তিন মণ ওজনের গরুর দাম ২৪-৩০ হাজার টাকা বেশি।

ব্যাপারীদের যুক্তি, মাংসের দামের ওপর নির্ভর করে কোরবানির পশুর দাম। গত বছর ৬০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ৭৫০ টাকা হয়েছে সেই মাংসের দাম। ফলে প্রতি মণ মাংসে দাম বেড়েছে ৬ হাজার টাকা। এতে করে তিন মণ ওজনের গরুর দাম বেড়েছে ১৮ হাজার টাকা।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরিফুর রহমান স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছিলেন গাবতলীর হাটে। বেশ কয়েকটি গরু তাঁর পছন্দ হয়েছে। তবে দামে না মেলায় কিনতে পারেননি। আরিফ জানান, তাঁরা তিন ভাই মিলে গরু কেনেন। গতবার মাঝারি আকারের গরু কিনেছিলেন ৯৭ হাজার টাকায়। একই ধরনের গরু এবার দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হাঁকছেন ব্যাপারীরা।

মোহাম্মদপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আহসান উল্যাহ বলেন, কয়েক বছর ধরে ১০ হাজার টাকার মধ্যে এক ভাগে কোরবানি দিতে পারলেও এ বছর তা সম্ভব হবে কিনা জানি না।

সংকটে খামারিরা
পশুপালন খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত দেড় বছরে পশুখাদ্যের কিছু উপকরণের দাম এখন দ্বিগুণেরও বেশি। পাশাপাশি ওষুধ, বিদ্যুৎ, কর্মচারীদের বেতনসহ সার্বিক উৎপাদন খরচও বেড়েছে খামারিদের।
খামারিরা জানান, ৩৭ কেজি ওজনের এক বস্তা গমের ভুসির এখন বাজার দর ২ হাজার ২০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা, দুই বছর আগে ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। ৭৪ কেজির এক বস্তা খৈল ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। ৫০ কেজি ওজনের ধানের কুঁড়ার বস্তা ৯০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৭০০ টাকা। প্রতি কেজি খড় ১৫ টাকা, আগে ছিল ১০ টাকা। এ ছাড়া খেসারি ও ছোলার ভুসির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। এ ছাড়া খামার শ্রমিকদের দুই বছর আগে মাসিক বেতন ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এখন কোনো শ্রমিক ১৫ হাজার টাকার নিচে কাজ করতে চান না। এর মধ্যে আবার দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। টিকতে না পেরে দেশের ১৫-২০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে বলে দাবি করছে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ছোট-বড় ১০ লাখের বেশি ডেইরি ও ফ্যাটেনিং খামার রয়েছে। মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই এসব খামার লোকসানে রয়েছে। অনেক গুটিয়েও নিয়েছে।

বিডিএফএর সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, খামার পরিচালনায় পানি-বিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক সব খরচই ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবে মানুষের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় গোখাদ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, সে হারে পশুর দাম বাড়ানো যায়নি। খামারিরা লাভের অঙ্ক কমিয়ে গরু বিক্রি করছেন। তবু অন্যান্য বছরের মতো কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকলে তাঁরা ভীষণ চাপে পড়বেন। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কম দামে গরু-ছাগল বিক্রি করতে পারবেন খামারিরা। আবার আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানি কম হলে উদ্বৃত্ত পশু আরও এক বছর লালন-পালন করতে হবে।

তবে ব্যাপারী ও খামারিদের অনেকের ধারণা, জাতীয় নির্বাচনের আগে এটিই শেষ কোরবানির ঈদ হওয়ায় রাজনৈতিক নেতারা অনেকে বড় গরু কিনে মাংস বিতরণের প্রতিযোগিতায় নামবেন। ফলে সব মিলিয়ে ছোট ও বড় আকারের গরু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
ঈদের আগে লাম্পি স্কিন রোগের সংক্রমণ

বিভিন্ন জেলায় হঠাৎ করে গবাদি পশুর শরীরে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) বেড়ে গেছে। এতে খামারিদের লাভের স্বপ্নে হঠাৎ ধাক্কা লেগেছে। ২০১৬ সালের দিকে প্রথম ঝিনাইদহ, যশোরে গরুর মধ্যে এলএসডি শনাক্ত হয়। তবে এবার ঈদের আগে সংক্রমণ বেড়েছে। আক্রান্ত গরু হাটে তোলা যাচ্ছে না। কোরবানির ঈদের আগে এমন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় চিন্তায় পড়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে ২৯ জেলায় ছড়িয়েছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ। এসব জেলায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩ লাখ গরু। বেশকিছু গরু মারাও গেছে।

খামারিদের অভিযোগ, রোগটি ব্যাপক আকার ধারণ করলেও মাঠে দেখা যাচ্ছে না প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
প্রাণী চিকিৎসকরা বলছেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ বছর বর্ষার আগেই লাম্পি স্কিনের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। তবে তা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়াচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার বলেন, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি উপজেলায় ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালু আছে। দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা দাম নির্ধারণ করে দিতে পারি না। আমরা শুধু উৎপাদন খরচ নির্ধারণ করে দিতে পারি। গবাদি পশুর উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি প্রায় ৫৫০ টাকা। যেহেতু পশুর সরবরাহ বেশি, ফলে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর সুযোগও কম। অনলাইন, সরাসরি খামার এবং বাড়ি থেকে গরু কেনার পাশাপাশি কেউ চাইলে হাটে নেওয়ার আগে চলতি পথেও গরু বিক্রি করতে পারবে। এতে করে গবাদিপশুর দামের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়াভাবে কারও হাতে থাকবে না।

https://samakal.com/bangladesh/article/2306180313