২৬ জুন ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৫

শিক্ষকসংকটে প্রাইভেট পড়ে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট। এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী বাড়তি টাকা খরচ করে প্রাইভেট পড়ছে। প্রাইভেট না পড়লে নানামুখী সমস্যায় পড়ছে তারা। প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হবে বলে মনে করেন জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ মানুষ।

গতকাল রবিবার রাজধানীর খামারবাড়ি এলাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ, স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে জরিপের এসব তথ্য প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডি উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারীর ৩০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪০৮ জনের ওপর জরিপ করে এসব তথ্য জানিয়েছে। সম্মেলনে জরিপের ফলাফল নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, জরিপ করা ৩০টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪টিতে পাঁচটির কম শ্রেণিকক্ষ রয়েছে, যা প্রয়োজনের চেয়ে কম।
বাকিগুলোর মধ্যে আটটি বিদ্যালয়ে পাঁচটির বেশি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। বাকি আটটি বিদ্যালয়ে পাঁচটি করে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে।
বিদ্যালয়ে শিক্ষকের গড় সংখ্যা ছিল ছয়জন। সেখানকার শিক্ষার্থীর বিবেচনায় গড়ে ২৯ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক আছেন, যা জাতীয় হারের চেয়েও কম।

কিন্তু সমস্যা হয় যখন কোনো শিক্ষক বদলি হন বা অনুপস্থিত থাকেন। তখন ক্লাস নিতে সমস্যা হয়। অন্যদিকে বিদ্যালয়গুলোতে অফিস সহায়ক না থাকায় প্রধান শিক্ষকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এতে তিনি পাঠদান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না।

সিপিডি বলছে, দারিদ্র্যের হার গাইবান্ধায় জাতীয় হারের প্রায় দ্বিগুণ।
ঠাকুরগাঁও জেলায় এই হার জাতীয় হারের চেয়ে কম হলেও নীলফামারীতে আবার তা জাতীয় হারের চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি। ঠাকুরগাঁও জেলায় সাক্ষরতার হার জাতীয় হারের বেশি হলেও গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে তা জাতীয় হারের চেয়ে কম। আবার গাইবান্ধা জেলায় বাল্যবিবাহের হার জাতীয় হারের চেয়ে প্রায় ১১ শতাংশ বেশি।

সম্মেলনে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সিপিডি উত্তরের তিন জেলায় প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে তিনটি সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করে। এতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে।

তিনি আরো বলেন, গত পাঁচ বছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বাজেট কমানো হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৬.৫১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয়েছে ৪.৫৬ শতাংশে। এ ছাড়া মোট সরকারি ব্যয়ের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬.৩৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪.৫৩ শতাংশ হয়েছে।

জরিপে আরো দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে জিডিপির তুলনায়ও বরাদ্দ কমেছে। এই মন্ত্রণালয়ে জিডিপির তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ০.৯৫ শতাংশ, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ০.৬৯ শতাংশ। জিডিপির অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ০.৭৪ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে দাঁড়িয়েছে ০.৫৯ শতাংশ। জরিপের তথ্য বলছে, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ অংশীজন। জরিপ করা ৩০ বিদ্যালয়ের মধ্যে ২২টিতে কোনো ধরনের গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা নেই। ইংরেজি ও গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষ দুর্বলতার কথা জানিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ উত্তরদাতা।

সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেকেই ভাবেন যে সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় বা শিক্ষা খাতে বাজেটে কম বরাদ্দ রাখছে। কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। আমাদের সব জায়গাতেই হিসাব করে বরাদ্দ দিতে হয়।’

সম্মেলনে গুণগত মানসম্মত শিক্ষকের ওপর গুরুত্বারোপ করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘উন্নত মানের শিক্ষক দরকার। শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে চাকরির সর্বশেষ পছন্দ হলে এগোনো যাবে না। শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রথম বা দ্বিতীয় পছন্দ হওয়া দরকার।’

এ সময় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এই উন্নয়নের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে বৈষম্য। সমাজে যেমন বেড়েছে আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য তেমনি বেড়েছে শিক্ষার বৈষম্য। প্রাথমিকে শিক্ষার অদক্ষতার কারণে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারছি না। আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ করতে পারছি না। এখন আমাদের প্রয়োজন শুধু শিক্ষার প্রসার নয়, মানসম্মত শিক্ষার প্রসার।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/06/26/1293530