২৬ জুন ২০২৩, সোমবার, ১২:৩৮

ফুটপাতের হকার থেকে রেকার বিল আদায়

সড়ক থেকে বিকল গাড়ি অপসারণ ও অবৈধ পার্কিং বন্ধে রেকার বিল আদায়ের নিয়ম রয়েছে। এখন রাজধানীর ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও ‘রেকার বিল’ আদায় করা হচ্ছে। ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রসিদ। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কোরবানির ঈদের আগে সোনারগাঁও হোটেল থেকে পান্থপথ মোড় পর্যন্ত সড়কের এক পাশের ফুটপাত থেকে এভাবে চাঁদাবাজি করছে ট্রাফিক পুলিশ।

পান্থপথ ছাড়াও রাজধানীর প্রায় সব এলাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজি চলছে বলে হকাররা অভিযোগ করেছেন। তাঁরা বলছেন, ঈদের আগে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। পুলিশ ও এলাকার প্রভাবশালীদের নামে চাঁদা তুলছেন লাইনম্যানরা। অবশ্য চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।

পান্থপথ সড়কের ফুটপাতের (পশ্চিম পাশ) পাশে গত ১৭ জুন রেকার দাঁড় করিয়ে ‘বিল’ নিতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশকে।
সেখানে পোশাক, জুতা, মৌসুমি ফলসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দোকান রেকারে তোলার ভয় দেখিয়ে বিল আদায় করতে দেখা যায়। এ সময় ব্যবসায়ীদের হাতে রসিদও ধরিয়ে দেওয়া হয়।

গতকাল রবিবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ টাকা নিয়েছে।
তবে রেকার দূরে রাখা ছিল। এভাবে সারা মাস টাকা আদায় করেছে ট্রাফিক পুলিশ।

ফুটপাতের অন্তত ৫০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদ সামনে রেখে চলতি জুন মাসের শুরু থেকে দু-এক দিন পর পর ট্রাফিক পুলিশ চাঁদা তুলছে। সর্বশেষ ১৭ জুন রেকার বিলের রসিদ ধরিয়ে তাঁদের কাছ থেকে অন্তত দেড় লাখ টাকা আদায় করা হয়। আগের সাত দিনও একইভাবে টাকা আদায় করা হয়।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ঘুরে ঘুরে কারো কাছ থেকে এক হাজার ২০০, কারো কাছ থেকে ৬০০ আবার কারো কাছ থেকে ৫০০ টাকা রেকার বিল নেন। এভাবে টাকা আদায়ের সময় তাঁরা বলে গেছেন, ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে দোকানপ্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। না হলে সব দোকান রেকারে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। গ্রেপ্তারও করা হবে।

খোঁজ করে পান্থপথের ১২ জন ব্যবসায়ীর কাছে রেকার বিলের রসিদ পাওয়া গেছে। একটি রসিদে লেখা—তারিখ ১৭-০৬-২০২৩, রেকার স্লিপ নম্বর ১২৭১৮০, ব্যবহৃত রেকার নম্বর ২, রেজিস্ট্রেশন নম্বরবিহীন, ড্রাইভার/মালিকের নাম আ. রাজ্জাক, রেকার বিল ১২০০ টাকা। আদেশক্রমে উপপুলিশ কমিশনার, ট্রাফিক রমনা বিভাগ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

ভুক্তভোগী একজন বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা আমাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিয়েছেন। সেই সঙ্গে বলে গেছেন, প্রত্যেককে মাসে ১০ হাজার টাকা রেকার বিল দিতে হবে।’

ওই ফুটপাতের হালিম বিক্রেতা মো. সালাম বলেন, হালিম বিক্রি করে সারা দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা লাভ হয়। এই টাকা দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খবার, ঘরভাড়া দিতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর যদি চাঁদা দিতে হয় তাহলে পথে বসতে হবে।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন ও বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলে রাজধানীতে অন্তত দুই লাখ হকার আছেন। তাঁদের কাছ থেকে দোকানপ্রতি কম করে হলেও ৫০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। সে হিসাবে ফুটপাত থেকে দৈনিক ১০ কেটি টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। আর ঈদ সামনে রেখে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

এম এ কাশেম বলেন, চাঁদাবাজির বিষয়টি প্রশাসনের সবাই জানে। অথচ চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কারণ চাঁদার টাকা কমবেশি সবাই পায়। ফুটপাতে রেকার বিল আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু পান্থপথ নয়, রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ রেকারের ভয় দেখিয়ে টাকা নিচ্ছে। এটা এক ধরনের নীরব চাঁদাবাজির মতো।
অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাইলে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) মো. হাবিব মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে তাঁর মোবাইলে ফোন দিলেও ধরেননি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের ট্রাফিক উপকমিশনার সালমান পার্সী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আর রেকারের নামে ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া আইনত অপরাধ। খোঁজ নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে চাঁদাবাজি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু পান্থপথে নয়, ঈদ সামনে রেখে চলতি মাসের শুরু থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে চাঁদাবাজি বেড়েছে। ফুটপাত থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এসব টাকা যাচ্ছে কতিপয় পুলিশসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পকেটে।

বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত থেকে কিছু পুলিশের পাশাপাশি অন্তত সাড়ে ৪০০ ব্যক্তি চাঁদা তুলছেন। এঁদের বলা হয় লাইনম্যান। গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, মিরপুর ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, মুক্তবাংলা মার্কেট, উত্তরা ও পুরান ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা এই অভিযোগ করেন।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে এক লাখের বেশি হকার ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তবে চাঁদাবাজরা তাঁদের শান্তিতে থাকতে দেয় না। স্থানভেদে ১০০ থেকে এক হাজার টাকা দৈনিক চাঁদা নেওয়া হয়। ঈদের সময় চাঁদার পরিমাণ বাড়ে।
মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের সামেনের ফুটপাতের সুমন, আনোয়ারসহ ১০ জন ব্যবসায়ী বলেছেন, তাঁরা নিয়মিত কয়েক দফায় কখনো পুলিশকে আবার কখনো সিটি করপোরেশনের লোকজনকে চাঁদা দেন। অথচ টাকা দিয়েও কখনো কখনো তাঁরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কে কখন টাকা চায়, আবার কে কখন ভেঙে দেয়—সব সময়ই আতঙ্কে থাকেন তাঁরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে, আবার কোথাও দৈনিক হারে চাঁদা নেওয়া হয়। এলাকাভিত্তিক ২০ টাকা থেকে শুরু করে দৈনিক দোকানের আয়তন হিসাবে অন্তত ১০০, ১৫০, ২০০, কখনো কখনো ৩০০, আবার তার চেয়ে বেশিও টাকা নেওয়া হয়। এমন কোথাও নেই, যেখানে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা হয় না।

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন বলেন, ফুটপাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সিটি করপোরেশন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে মিরপুরে ফুটপাতে নির্দিষ্ট সময়ে অস্থায়ী দোকানি বসানো এবং তত্ত্বাবধানের জন্য ‘প্রতিনিধি’ নিয়োগের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের অধীনে ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য যে অভিযান পরিচালনা করা হয়, সেখানে পুলিশের সহায়তা থাকে। এতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ২১ জুন গণমাধ্যমকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজি করা যাবে না। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/26/1293517