২৫ জুন ২০২৩, রবিবার, ৯:২৯

ঈদ ঘিরে ভোগাচ্ছে মসলার বাজার

গলির দোকানে অনেক দাম! রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এসে ৩৬০ টাকায় এক কেজি আমদানি করা আদা কিনতে পেরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন জাফর আহমেদ। বেসরকারি এই চাকুরে ইদানীং খুব হিসাব কষেই বাজারে পা রাখেন। মসলা বাজারের দামের এমন ঝাঁজে তাঁর চোখেও লাগছে আঁচ। গতকাল শনিবার ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বললেন, ‘আগে যাও বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তরের আনাগোনা দেখতাম, এখন মনে হয় তারাও মিউজিয়ামে চলে গেছে। কোরবানির ঈদের আগে বাজারে তাদেরই আগে দরকার, অথচ দেখা নেই। সরকারের তদারকি না থাকলে যে যার মতো করে দাম নেবে, এটাই স্বাভাবিক।’

কোরবানির ঈদের আগে মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ে। সংকট আর সরবরাহের ছুতায় দামও ছোটে। এবার যেন সবকিছু ছাপিয়ে গেছে মসলার বাজার। অনেকে হাতই দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না!

কোনো কোনো মসলার দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই যেমন গত বছর এ সময়ে ব্যাংকার তানজিম আহমেদ এক কেজি জিরা কিনেছিলেন ৪০০ টাকায়। গতকাল সেই জিরা কিনতে কারওয়ান বাজারে গুনতে হয়েছে ৯০০ টাকা। এক বছর আগে আমদানি করা আদা কিনেছিলেন ১৩০ টাকা, গতকাল কিনেছেন ৩৬০ টাকায়।

কোরবানির সময় সাধারণত চাহিদা বাড়ে জিরা, এলাচ, দারচিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ইত্যাদি মসলাজাতীয় পণ্যের। তবে রোজার ঈদের পর থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এসব পণ্যের বাজার।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যই বলছে, এক বছরের ব্যবধানে জিরার দাম বেড়েছে ১৩২ শতাংশ। একইভাবে দারচিনির ১৪ শতাংশ, লবঙ্গের ৩৮, ধনিয়ার ৯৬, দেশি পেঁয়াজের ৫৮, দেশি আদার ২৮১, আমদানি করা আদার ১৭৯, দেশি রসুনের ১০০ এবং আমদানি করা রসুনের ২৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।

ভোক্তাদের অভিযোগ, কোরবানির ঈদ ঘিরে ব্যবসায়ীরা মসলার গলাকাটা দাম রাখছেন। বাজারে কার্যত সরকারের কোনো তদারকি নেই। সে জন্য যে যাঁর মতো করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছেন। অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে।
মসলার কেমন দরদাম

গতকাল কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটসহ কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ১০০০ টাকা দরে। দুই মাস আগে জিরার কেজি ছিল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই হিসাবে দুই মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। তবে এক বছর আগে পণ্যটির দাম ছিল আরও কম। তখন বিক্রি হয়েছে ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকা দরে। টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছরে জিরার দাম বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।

একইভাবে লবঙ্গের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায়। এক বছর আগে এর দাম ছিল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় গত বছর দারচিনির কেজি বিক্রি হয়েছে। কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৫২০ টাকায়। ধনিয়ার কেজি এখন ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। অথচ গত বছর কেনা গেছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা।

গত দুই মাসে এলাচের দাম ২০০ টাকার মতো বেড়েছে। রোজার ঈদের পর মানভেদে এলাচের কেজি ছিল ১৬০০ থেকে ২৬০০ টাকা। এখন দাম বেড়ে মসলাটি বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ২৮০০ টাকা।

পেঁয়াজ-আদা-রসুনের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। আমদানি বন্ধের অজুহাতে হু হু করে দাম বেড়েছিল পেঁয়াজের। দেড় মাসের মাথায় প্রায় তিন গুণ উঠেছিল দাম। এরপর সরকার ফের আমদানির অনুমতি দেয়। এখন প্রতিদিন শত শত টন আমদানি হওয়ায় বাজার ভরে গেছে ভারতীয় পেঁয়াজে। এসব পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে এখনও নাগালে আসেনি দেশি পেঁয়াজ। এ ধরনের পেঁয়াজের কেজিতে এখনও ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অথচ গত বছরের এ সময় পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।

মাসখানেক আগে আদার দাম বেড়ে ৫০০ টাকা ছুঁয়েছিল। এরপর কিছুটা কমলেও এখনও গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। খুচরা ব্যবসায়ীরা এখন আমদানি করা আদার কেজি ৩৫০ থেকে ৪০০ এবং দেশি আদার কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এক বছর আগে আমদানি করা আদার দাম ১২০ থেকে ১৫০ এবং দেশি আদার কেজি ছিল ৬০ থেকে ১০০ টাকা।
বেড়েছে রসুনের দামও। দেশি রসুনের কেজি এখন ১২০ থেকে ১৬০ টাকা এবং আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। গত বছর এ সময় দেশি রসুন ৬০ থেকে ৮০ এবং আমদানি করা রসুনের কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।
পাইকারি ও আমদানিকারকদের দুষছেন বিক্রেতারা

মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে পাইকারি ও আমদানিকারকদের দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা। মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের আলম স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. রাসেল বলেন, রোজার পর থেকে সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের আবদুর রব স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. নাঈম বলেন, গত চার-পাঁচ দিনেই জিরার দাম কেজিতে অন্তত ১০০ টাকা বেড়েছে পাইকারি দোকানে।

তবে আমদানিকারকদের দাবি, ডলারের বাড়তি দাম ও সংকটের কারণে মসলার বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমার ৫০ বছরের জীবনে মসলার দরের এমন ঊর্ধ্বগতি আগে দেখিনি। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেটের সঙ্গে ডলার রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে মসলার দর ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ কারণে প্রায় সব মসলার দর অনেক বেড়েছে।’

এ অবস্থা কত দিন চলবে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের কোনো ধারণাই কাজে আসছে না। আমরা ব্যবসায়ীরাই বুঝতে পারছি না, দর কোথায় গিয়ে ঠেকবে। ফলে এ প্রশ্নের উত্তর নেই। ঈদের পর দেখা যাক, কী হয়!’
চিনির বাজার এখনও বেসামাল

খুচরা পর্যায়ে সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে চিনি কেজিতে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলো কৌশলে চিনি দেওয়া বন্ধ রেখেছে। এ কারণে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।

খুচরা পর্যায়ে খোলা চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে। অথচ সপ্তাহখানেক আগে এ চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে।

কয়েক মাস ধরে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। গত মে মাসে সরকার খোলা চিনির কেজি ১২০ ও প্যাকেটজাত চিনির দর ১২৫ টাকা বেঁধে দেয়। যখন এ দর নির্ধারণ করা হয়, তখনও বাজারে ১৪০ টাকার আশপাশে ছিল দাম। অব্যাহত থাকা সেই দরে ঘি ঢেলেছে গত ১৯ জুনের চিঠি। ওই দিন দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দিয়েছে চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি খোলা চিনি কেজিতে ২০ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনিতে ২৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে খোলা চিনির কেজি ১৪০ ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৫০ টাকায় পৌঁছবে। তবে তাদের এ সিদ্ধান্ত ঈদের আগে কার্যকর না করার আহ্বান জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে কাগজে-কলমে না বাড়লেও অঘোষিতভাবে বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারেও চিনির বস্তা (৫০ কেজি) ৬ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৭০০ টাকায় দাম উঠেছে। এখন কোনো কোনো কোম্পানি বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।

তেজকুনিপাড়া এলাকার চিনি ব্যবসায়ী মো. হেলাল বলেন, তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কোম্পানি থেকে প্যাকেট চিনি সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে কিছু খোলা চিনি দিচ্ছে। টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় চিনির দাম এখন ৭৭ শতাংশ বেশি।
অন্য পণ্যেও স্বস্তি নেই

কোরবানির সময় সালাদের জন্য কাঁচামরিচ, শসা ও টমেটোজাতীয় সবজির দরকার হয় বেশি। বাজারে এখন এগুলোর দামও বেড়েছে। চার-পাঁচ দিন আগে কাঁচামরিচের কেজি ছিল ১০০ টাকার আশপাশে। দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। শসার কেজি এক সপ্তাহ আগে ৪০ থেকে ৫০ টাকা ছিল। এখন ক্রেতাকে খরচ করতে হচ্ছে কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ ছাড়া মৌসুম শেষ হওয়ায় টমেটোর দামও বেড়েছে। গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের কাঁচামালের আড়তদার ইদ্রিস মিয়া বলেন, সবজি মজুত করা যায় না। ব্যাপারীরা যখন যে দর দেন, সেই দরেই বিক্রি করা লাগে। বাজারে সরবরাহ কম হলে দাম বেড়ে যায়। সব সময় এভাবেই চলে।
কারা কী বলছেন

সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, দেশ এখন অতি মুনাফাখোরদের খপ্পরে পড়েছে। সবকিছুতেই অতি মুনাফা যেন জাতীয় রোগে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, রোজার পর থেকেই ধীরে ধীরে মসলার দাম বাড়াতে থাকেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক বছরের ব্যবধানে কয়েকটি মসলার দাম তিন-চার গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কয়েকটি সবজির দামও আকাশছোঁয়া।

তিনি বলেন, সরকারের সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকির অভাবে বাজার ব্যবসায়ীদের পুরো নিয়ন্ত্রণে। কোরবানির ঈদে মসলার চাহিদা বেশি থাকায় দাম কিছুটা বাড়তেই পারে। তবে বাড়ার যে হার, সেটা অস্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরা একবার এক পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভ নিয়ে চলে যান।

বাণিজ্যমন্ত্রী বারবার বাজার তদারকি জোরদার করার ব্যাপারে নির্দেশ দিলেও কার্যত সেভাবে তদারকি হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘আপনি তো বাজার নিয়ে সব সময় রিপোর্ট করেন। আপনার কি মনে হয়, বাজার কি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব? তার পরও আমরা কাজ করছি।’ তবে তাঁদের একার পক্ষে বাজারের জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

https://samakal.com/economics/article/2306180140