২৪ জুন ২০২৩, শনিবার, ৮:৪২

ঈদ সামনে রেখে তৎপর ছিনতাইকারী অজ্ঞান ও মলম পার্টি

কুরবানির ঈদ সামনে রেখে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার হাটগুলোতে পশু আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে গরুর বেপারী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের টার্গেট করে ডাকাত-ছিনতাইকারী, মলম ও অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। পশুর হাটকে কেন্দ্র করে ‘মৌসুমি অপরাধী’রাও বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। পশু বেপারীদের টার্গেট করে মাঠে নেমেছে এই চক্র। এ ছাড়াও পশুর হাটকেন্দ্রিক নগদ টাকার লেনদেন বেড়ে যায়। অনেকে নগদ টাকা বহন করে থাকেন। নগদ টাকার লেনদেনের সুযোগে মানুষকে চেতনা নাশক দ্রব্য সেবন করিয়ে বা বিষাক্ত স্প্রে দিয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায় অপরাধী চক্র।

তবে ‘মৌসুমী অপরাধীদের’ ধরতে ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, শুধু রাজধানীতেই অন্তত ৫০টি গ্রুপের প্রায় ছয় শতাধিক পেশাদার অপরাধী মৌসুমভিত্তিক অপরাধমূলক কাজ করছে। তারা এ ধরনের অপরাধ ঘটিয়েই ঢাকার বাইরে পালিয়ে যায়। এসব অপরাধী চক্রের হোতারা বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হলেও স্বল্প সময়ে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই অপরাধ ঘটায়। তাই একেবারে রোধ করা যাচ্ছে না ভয়ঙ্কর এসব অপরাধ। ফলে এ পেশাদার অপরাধীদের ভয়ঙ্কর নির্মমতার শিকার হচ্ছেন পথেঘাটে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ।

গত ২২ জুন ডিএমপি সদর দপ্তরে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, ঈদে ফাঁকা ঢাকায় যাতে চুরি ডাকাতি না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেব। ঢাকাবাসীর প্রতি অনুরোধ করব, আপনারা যখন ৪-৫ দিনের জন্য বাসা ফাঁকা রেখে গ্রামের বাড়িতে যাবেন, তখন দয়া করে মূল্যবান বস্তু অর্থাৎ নগদ টাকা এবং গহনা খালি বাসায় না রেখে ব্যাংকে রাখেন বা নিকট আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব বা যারা থাকবেন তাদের কাছে জমা রেখে যাবেন। ফাঁকা বাসায় কোনো দুষ্কৃতকারী যদি ঢুকে তাহলে মূল্যবান বস্তু চুরির ভয় থাকবে না। ডিএমপির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সভায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা মনিটরিং; বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশন কেন্দ্রিক নিরাপত্তা; গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ ও গমনাগমন; বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক নিরাপত্তা; ঈদ জামাত ও ঈদ পরবর্তী সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবারের ঈদে ঢাকার ফাঁকা অলি-গলিতে টহল বাড়ানো হবে। সড়কে বাড়বে চেকপোস্ট। বাসা-বাড়ির সিসিটিভি মনিটরিং করতে বাসা মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে বলেও বৈঠকে আলোচনা হয়। ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, ঈদ কেন্দ্রিক নিরাপত্তায় ডিএমপি কমিশনার বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ঈদের আগে কুরবানির পশুর হাটে অজ্ঞান-মলমপার্টির দৌরাত্ম্য রোধ, টাকা লেনদেনে নিরাপত্তা, ব্যাংক পাড়ায় বা ব্যাংকে বিশেষ নিরাপত্তা, ঈদের দিন কুরবানি, পশুর চামড়া বিক্রি কেন্দ্রিক সুষ্ঠু ব্যবস্থায় নজর রাখা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এজন্য চুরি ও ডাকাতির ডাটাবেজ অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত পলাতক চোর, ডাকাতদের গ্রেফতার ও যথাসম্ভব নজরদারি বাড়ানো ও অভিযান পরিচালনা করতে সব বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তায় অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এবারের ঈদে নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব জানায়, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, অজ্ঞান পার্টি বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে সারা দেশেই। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা ঘোরাফেরা করতে থাকে। সহজ সরল যাত্রীদের টার্গেট করে কখনও তাদেরকে ডাব, কোমল পানীয় কিংবা পানির সঙ্গে বিষাক্ত চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আবার কখনও যাত্রীবেশে বাস ও ট্রেনে চড়ে যাত্রীদের পাশে বসে তাদের নাকের কাছে চেতনানাশক ওষুধে ভেজানো রুমাল দিয়ে যাত্রীদের অজ্ঞান করে থাকে। ওই বিষাক্ত পানীয় সেবন করার বা বিষাক্ত স্প্রের ঘ্রাণ নেয়ার পর ওই যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার সর্বস্ব কেড়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। এরপর তারা ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। এছাড়াও কখনও ভিড়ের মধ্যে যাত্রীদের চোখে-মুখে বিষাক্ত মলম বা মরিচের গুঁড়ো বা বিষাক্ত স্প্রে করে যাত্রীদের যন্ত্রণায় কাতর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। অজ্ঞানপার্টির শিকার ব্যক্তি শারীরিকভাবে দুর্বল ও বয়স্ক হলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অন্যদিকে ভুক্তভোগীর চোখে-মুখে বিষাক্ত মলম লাগানোর ফলে তার দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। এসব অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা নির্বিঘেœ তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে বেড়ে যায় চাঁদাবাজিও। পেশাদার অপরাধী থেকে শুরু করে মৌসুমি অপরাধী, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার চিহ্নিত অপরাধীদের সঙ্গে পাশের জেলাগুলো থেকে আসা চোর, ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। চুরি ও ডাকাতির জন্য মাসিক-দৈনিক মজুরিতে কিশোর-যুবকদের ভাড়া করে থাকে অপরাধীচক্র। দুষ্কৃতকারীরা দলবদ্ধভাবে ঢাকা শহরের ব্যস্ততম বাস স্টপেজে অবস্থান করে কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে। পরে যাত্রীবেশে বাসে উঠে সুযোগ বুঝে টার্গেট করা ব্যক্তিকে সুকৌশলে চেতনানাশক উপাদান প্রয়োগের মাধ্যমে অচেতন করে তাদের সঙ্গে থাকা নগদ টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়ে যায়। অপরদিকে রাজধানীতে মোবাইল ফোন বেশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে রাস্তায় যারা ছিঁচকে চোর-ছিনতাইকারী আছে, তারা রাস্তায় মোবাইল, স্বর্ণালঙ্কার টান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়, তাদের অধিকাংশই মাদকসেবী। চোরাই মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে চোরাই মোবাইল পুনরায় ব্যবহার হচ্ছে। আর এগুলো করার জন্য একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে হাতিরপুলের ইস্টার্নপ্লাজা, মোতালেব প্লাজা, গুলিস্তান এলাকায় যে কেউ গিয়ে তাদের মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে নিতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ভাসমান মাদকাসক্ত। যখন তাদের কাছে মাদক কেনার টাকা থাকে না তখনই তারা মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে ও পকেট থেকে টান মেরে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধে পুলিশের ক্রাইম বিভাগের প্যাট্রোল টিম ও ডিবির ছিনতাই প্রতিরোধ টিম রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করে। সেসব পয়েন্ট থেকে নিয়মিত এসব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ছিনতাইকারী গ্রেফতার হচ্ছে। গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

https://dailysangram.info/post/528312