২৪ জুন ২০২৩, শনিবার, ৮:৩০

গমের বাজারে নৈরাজ্য

-ইবনে নূরুল হুদা

আমাদের দেশের মত এতো অস্থিতিশীল ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। কার্যত আমাদের বাজারের ওপর সরকার বা সরকারি কোন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেই বরং বাজার চলে অসাধু ব্যবসায়ি ও বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে এবং স্বশাসনে। মূলত তারাই বাজারের দ-মু-ের কর্তা। বাজারের এসব কুশীলবরা নিজেদের ইচ্ছামত পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে অধিক মুনাফা অর্জন করেন। আর এভাবেই কথিত ব্যবসায়ি নামের অতিমুনাফাখোর গোষ্ঠী ভোক্তা সাধারণের রক্ত শোষণ করেন অবললীয়।
একথা অস্বীকার সুযোগ নেই যে, প্রতিনিয়ত মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশের বাজার ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদন ঘাটতি, পণ্য সরবরাহে জটিলতা, উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয়বৃদ্ধির সহ নানা কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখানো রীতিমত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এটিকেই মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে সেটিকে অজুহাত বানিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও কাকতালীয়ভাবে অধিকহারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হয়। এক্ষেত্রে বর্ধিত মূল্যের নতুন চালান আসার প্রয়োজন হয় না বরং মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ পৌঁছামাত্র অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বংয়ক্রীয়ভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটে। যা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।

পক্ষান্তরে বিশ্ববাজারে যখন কোন পণ্যের মূল্য কমে যায়, তখন অভ্যন্তরীণ বাজারে এর কোন প্রভাব পড়ে না বা ভোক্তা সাধারণ সে সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। কারণ, এক্ষেত্রে দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়িরা দাবি করে বসেন যে, হ্রাসকৃত মূল্যের পণ্যের নতুন চালান এখন পর্যন্ত দেশে এসে পৌঁছায়নি। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে এর কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই। আর এ অবস্থা চলতে চলতেই ঘটে আন্তর্জাতিক বাজারের নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। সে অজুহাতে আবরো নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। আর এভাবেই চলছে আমাদের বাজার ব্যবস্থার দিনকাল। ফলে ভোক্তাদের পকেট কাটার মওকাটা কাজে লাগানো হচ্ছে বেশ স্বার্থকবাবেই। এতে একশ্রেণির অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে ওঠে দুর্বিসহ। এক সময় রূপ নেয় জনদুর্ভোগের।

একথা ঠিক যে, করোনা মহামারীর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে বেশ বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এমনকি বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিকভাবে মূল্যস্ফীতিও ঘটেছে। চলমান যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানী-রপ্তানী প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় খাদ্যপণ্যের মূল্যও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে গমের দামে রেকর্ড গড়েছিল নিকট অতীতে। যদিও তা বছরখানেক আগের কথা। তবে সে অবস্থা ইতোমধ্যেই অনেকটা কেটে যেতে শুরু করেছে। মূলত, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শস্যচুক্তির কল্যাণে এখন বিশ্ববাজারে গমের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত এক বছরের মধ্যে অস্থিতিশীল হয়নি বৈশ্বিক গমের বাজার বরং হ্রাস পেয়েছে ব্যাপকভাবে। তবে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে এর তেমনকোন প্রভাব নেই। এই মূল্যহ্রাসের কারণে আটা-ময়দার দাম তো তেমন কমেই নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেড়েছে। যার প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতেও। যা এখন বেশ উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে। বিষয়টিকে দেশের অসাধু ব্যবসায়িদের চরম দায়িত্বহীনতা ও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞমহল।

আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষক সংস্থা বিজনেস ইনসাইডারের তথ্য বলছে, গত বছর জুন মাসে মাঝামাঝি সময় আটা তৈরির গমের টনপ্রতি আমদানিমূল্য ছিল ৪শ ডলারের ওপরে, যা এবছর জুনে ২৫০ ডলারের নিচে। এ এক বছরের মাঝের সময় টানা কমেছে পণ্যটির দাম। আন্তর্জাতিক বেশকিছু সংবাদ সংস্থা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশ দু’টি থেকে গম আমদানি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শস্যচুক্তির কল্যাণে গত বছরের শেষে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি শুরু হয়। তাতে বিশ্ববাজারে গমের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকায়, আমদানি কমায় ও কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য সরবরাহ চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোয় বিশ্ববাজারে গমের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আর এ নি¤œমূখীতার ধারা এখন পর্যন্ত অব্যাহতই রয়ে গেছে।

দুঃখজনক হলেও যে, বিশ্ববাজারে এই নিম্নমুখিতার পরেও দেশে একই সময়ের ব্যবধানে খুচরা বাজারে আটার দাম অনেকটা বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত বছর জুন মাসে প্যাকেটজাত এক কেজি আটার দাম ছিল ৪৮ টাকা, এখন তা ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ৬৩ প্যাকেট ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে খোলা আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। দামের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলছেন সেই গৎবাঁধা কথা। তাদের দাবি, আটা-ময়দার দাম বাড়ার জন্য কয়েকটি কারণ দায়ী। এক, কম দামের গম এখনো দেশে এসে পৌঁছায়নি। এছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তাদের এই দাবিকে অসৎ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অজুহাত হিসাবেই দেখা হচ্ছে অভিজ্ঞমহলের পক্ষ থেকে। কারণ, তাদের এসব কথায় কোন অভিনবত্ব নেই বরং চর্বিত-চর্বন বলেই মনে করা হচ্ছে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ গম আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপ দাবি করছে, দাম কমলেও বর্তমান বাজারে যে পণ্য রয়েছে, সেই গম ৩৬০ ডলারে কেনা। এছাড়া আগে ৮৫-৮৬ টাকা ছিল ডলার রেট, আজ ১১৪ থেকে ১১৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এমন দাবিও করছে যে, প্যাকেটজাত আটা-ময়দার দাম না কমলেও এ সময় গমের দাম প্রতি মণ ৪শ টাকা কমেছে, যা ১ হাজার ৮শ থেকে ১ হাজার ৪শ টাকা হয়েছে। এছাড়া গমের আমদানি চাহিদার তুলনায় অনেক কম। গমের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে দাম বাড়তি রয়ে গেছে। তাদের এই দাবিকে অনেকটাই হাস্যকর বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অবশ্য সরকারি সূত্র বলছে, এবছর গমের আমদানি কিছুটা কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের ১৯ জুন পর্যন্ত (১১ মাস ১৯ দিন) গম আমদানি হয়েছে ৩৬ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময় ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার টন। তবে দেশে দ্বিতীয় এ প্রধান খাদ্যশস্য গমের উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশে বছরে গম উৎপাদন হয় ১১ লাখ টন। যেখানে চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ টন। দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাতের পরই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় গমের তৈরি উপকরণ। এ কারণে গমের সরবরাহ কমে দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ে।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত সাত বছরে দেশে গমের উৎপাদন কমেছে আড়াই লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সারাদেশে গত সাত বছরে গমের আবাদ কমেছে তিন লাখ একর জমিতে। এতে উৎপাদন কমেছে আড়াই লাখ টনেরও বেশি। তথ্য বলছে, সারাদেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ লাখ ৯৯ হাজার একর জমিতে গমের চাষ হয়েছিল। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ১৩ লাখ ৪৮ হাজার টন, যা ক্রমান্বয়ে কমে গত অর্থবছর (২০২১-২২) এসে আবাদি জমির পরিমাণ আট লাখ দুই হাজার একরে ঠেকেছে। এসময় উৎপাদন নেমেছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টনে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গমের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শীতের প্রয়োজন হয়। এখন শীতের সময়কাল দিন দিন কমছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে গম চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক।

এদিকে আটা-ময়দার দামের প্রভাব রপ্তানিতেও পড়েছে। জানা গেছে, এবছর কৃষিপণ্য রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। যার একটি বড় কারণ হচ্ছে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি। অন্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কারণ, প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দামও বেশি। যে কারণে আটা, ময়দা, তেল, চিনির মতো পণ্যগুলোর মাধ্যমে তৈরি হিমায়িত খাবারের খরচ বেড়েছে। ফলে রপ্তানীতে পড়েছে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। এতে বাণিজ্য ঘাটতি আগের তুলনায় বেড়েছে।
জানা গেছে, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট ও চানাচুরজাতীয় শুকনা খাবারসহ বিভিন্ন কনফেকশনারি। শেষ ১১ মাসে এ ধরনের পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ২৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা গত বছর একই সময়ে ২৭ কোটি ডলার ছিল। এটা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৮ শতাংশ কম।

এ ধরনের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। সংগঠনটির পক্ষে বলা হচ্ছে, স্নাক্সজাতীয় খাবারে আমরা এখন একদম পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের দেশে আটা, ময়দা, তেল, চিনি, ডালডা এসবের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমাদের প্রতিযোগি ভারত-পাকিস্তানে এগুলোর দাম কম হওয়ায় তাদের খরচও কম। প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। বড় একটি অংশের অর্ডার হারাচ্ছি। যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

আমাদের দেশের অনিন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা এখন আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ^বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ধুঁয়া তুলে প্রতিনিয়ত পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হলেও যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাস পায় তখন তার সুবিধা ভোক্তা সাধারণ খুব একটা পায় না বরং নানা ছলাকলা ও অজুহাত দেখিয়ে পণ্যমূল্য কমানো হয় না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের রপ্তানী খাতেও। কারণ, বিশ^বাজারে পণ্যের মূল্য কম থাকলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশি মূল্যে কাঁচামাল কিনে প্রতিযোগি দেশগুলোর মত কমমূল্যে আমরা পণ্য রপ্তানী করতে পারি না। ফলে আমাদেরকে হারাতে হয় আন্তর্জাতিক বাজার। হ্রাস পায় রপ্তানী। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখবর নয়।

মূলত, করোনা মহামারীর নেতিবাচক প্রভাব এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকভাবে গমের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশের গম ও গমজাত পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধরত দেশগুলো থেকে বৈশি^ক বাজারে গম সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় গমের দাম অর্ধেকে নেমে আসলেও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে কোনভাবেই নৈরাজ্য থামছে বরং নানা অজুহাতে গম ও গমজাত পণ্যের দাম বর্ধিত মূল্যেই রয়ে গেছে।

এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম পুনঃনির্ধারণ না করা গেলে তা যেমন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ঠিক তেমনিভাবে রপ্তানি খাতেও সৃষ্টি হবে বড় ধরনের অচলাবস্থা। তাই এ বিষয়ে সরকার, বাণিজ্যমন্ত্রণালয় ও খাদ্যমন্ত্রণালয়কে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায় গমের বাজারে নৈরাজ্য কোন ভাবেই থামানো যাবে না। আমাদের অর্থনীতিও হয়ে উঠবে অস্থিতিশীল!

https://dailysangram.info/post/528259