১২ জুন ২০২৩, সোমবার, ৪:০৯

উৎপাদন-আমদানির চেয়ে বাজারে দাম অনেক বেশি

আমদানির তুলনায় খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যে পার্থক্য অনেক বেশি। কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের চেয়ে খুচরা দরেও একই পরিস্থিতি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে তার প্রতিফলন নেই। রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা বিষয়ক টাস্কফোর্সের সপ্তম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি গমের দাম এক বছরে কমেছে ৩৫ শতাংশ। অথচ দেশের বাজারে তা বেড়েছে ১২ থেকে ২৫ শতাংশ। রসুনের দাম ১৬ শতাংশ কমলেও দেশে বেড়েছে ৯৩ শতাংশ। প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৪৪ শতাংশ কমলেও স্থানীয় বাজারে কমেছে মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ২ শতাংশ। এ ছাড়া চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ৩৩ শতাংশ বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। আদার দাম ১৭২ শতাংশ বাড়লেও দেশের বাজারে বেড়েছে ২৪৫ শতাংশ।

টাস্কফোর্সের পর্যবেক্ষণ– কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা ও পেঁয়াজের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে তার প্রতিফলন নেই। তা ছাড়া পেঁয়াজের স্থানীয় চাষিদের সুরক্ষায় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আমদানির অনুমতি দেওয়াতে দেরি হওয়ায় এর সুযোগ নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তবে মসুর ডাল ও রসুনের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সঙ্গে স্থানীয় মূল্য ইতিবাচক। এ ছাড়া আদা ও চিনির আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোজ্যতেল ও চিনির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণনে পরিবেশক নিয়োগ আদেশ প্রতিপালিত হচ্ছে না। মৌসুমি শুল্ক না থাকায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্য একই পণ্যের আমদানীকৃত মূল্য দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হয়। কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের তুলনায় খুচরা মূল্যের অত্যধিক পার্থক্য রয়েছে।

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিকারকদের উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, দেশের ব্যাংকগুলো যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে পারছে না। তাই আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ছাড়া শতভাগ এলসি মার্জিনের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ডলার সরবরাহে ঘাটতি থাকায় সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার ক্রয়ের ফলে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদনি করা নিত্যপণ্য বন্দর থেকে দ্রুত খালাসের সুপারিশ করা হয়। কেননা, আমদানি পণ্য যথাসময়ে খালাস করতে না পারলে জাহাজের ডেমারেজ চার্জের কারণে আমদানি পণ্যের মূল্য বেড়ে যায়।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারি বিপণন প্রতিষ্ঠান টিসিবির ভূমিকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে সংস্থাটি ১ কোটি পরিবারের মাঝে কম মূল্যে ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি চিনি ও এক কেজি মসুর ডাল বিক্রি করছে। এ জন্য টিসিবি আন্তর্জাতিক উৎসের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহ করে। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহ না করে বিদেশ থেকে করলে সরবরাহ আরও বাড়বে। তা ছাড়া সংস্থাটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তাই এটি সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বাজারে স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারছে না।

টাস্কফোর্স মনে করে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং ইতোমধ্যে ইতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে জনবলের ঘাটতি থাকায় প্রতিনিয়ত দেশব্যাপী বাজার মনিটরিং কার্যক্রম আরও কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া বাজার মনিটরিংয়ে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি টেকসই সমাধান নয়। এ ক্ষেত্রে পণ্য বাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামো ও পলিসিগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি বাজারে যথাযথ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে স্পেসিফিক শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমন পেঁয়াজ, আদা ও রসুন মজুতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চাষিদের সুরক্ষায় আমদানি বন্ধ না করে মৌসুমি কর আরোপ করা যেতে পারে। ভোজ্যতেল ও চিনি বাজারজাতকরণে শতভাগ ‘কনজুমার প্যাক’ নিশ্চিত করা যেতে পারে। টিসিবির পণ্য স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে টিসিবির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

টাস্কফোর্স মনে করে, বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিযোগিতা কমিশনের মাধ্যমে পলিসি ও কাঠামোগত ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খোলার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারভিত্তিক ডলার সরবরাহ নিশ্চিত এবং শতভাগ মার্জিনের শর্ত শিথিল করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে ডলার সরবরাহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চীন থেকে আদা আমদানি বন্ধ থাকায় মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দর দিয়ে আদা আমদানিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোন ধাপে বেশি মুনাফা হচ্ছে, তা বের করার জন্য সমীক্ষা পরিচালনা করা যেতে পারে। পণ্য পরিমাণ ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন দ্রুত চূড়ান্তকরণ এবং জনবল বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, টাস্কফোর্সের সভায় সার্বিক বাজার পরিস্থিতি বিশেষ করে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের বাজারমূল্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব পণ্যের বর্তমানে আমদানি পরিস্থিতি কেমন, দাম কেমন হওয়া উচিত; এসব বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম কমেছে। সয়াবিন তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

https://www.samakal.com/economics/article/2306177684