১২ জুন ২০২৩, সোমবার, ৩:৫৯

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সার্বিক স্থিতিতে বড় ঘাটতি

- আয় না বাড়লে সঙ্কটসহ ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সার্বিক স্থিতিতে বড় ঘাটতিতে পড়েছে দেশ। বৈদেশিক ঋণসহ অন্যান্য দায়দেনা বেড়ে যাওয়ায় এ ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। সামনে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় না বাড়লে এ ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে ডলারের সঙ্কট। আর ডলার সঙ্কট বেড়ে গেলে ডলারের দাম আরো বেড়ে যাবে। আরো কমে যাবে টাকার মান। এতে শুধু আমদানি ব্যয়ই বাড়বে না, সাথে মূল্যস্ফীতিসহ নানামুখী সঙ্কট দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪১০ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৫৬৫ কোটি ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৬৩.১২ শতাংশ। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ যে হারে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার আয় ওই হারে বাড়েনি। বরং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। তুলনামূলকভাবে বাড়েনি রফতানি আয়। ৯ মাসে রফতানি আয় বেড়েছে পৌনে ৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে এক হাজার ৪৬১ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। দেশে কর্মরত বিদেশী শ্রমিকদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৯ মাসে সেবা খাতে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৭৯ কোটি ডলার। আর এ সবের প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৯ মাসে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি বেড়েছে ১৬৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সামগ্রিক হিসাবের ঘাটতি ছিল যেখানে ৩০৯ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে বেড়ে হয়েছে ৮১৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রায় আয় কমে গেছে। বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণসহ নানা দায়দেনা বেড়ে গেছে। আর এ দায়দেনা বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক হিসেবের ঘাটতি বেড়ে গেছে। সামনে এ ঘাটতি আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন তারা। কারণ চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি থাকবে। কিন্তু রেমিট্যান্সসহ রফতানি আয় ওই হারে বাড়াতে না পারলে বৈদেশিক মুদ্রার এ সামগ্রিক ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। আর এ ঘাটতি বেড়ে গেলে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। গত বছরের ৭ জুন প্রতি ডলারের জন্য ব্যবসায়ীদের যেখানে ব্যয় করতে হয়েছিল ৯১ টাকা ৯৫ পয়সা, সেখানে চলতি বছরের ৭ জুনে তা বেড়ে হয়েছে ১০৮ টাকা ৪৫ পয়সা। শতকরা হিসাবে শুধু ডলারের বিপরীতে ব্যবসায়ীদের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মূল্যের এ তথ্য বাজারের অবস্থার সাথে একেবারেই অমিল। খোদ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো: জসিম উদ্দিন গত ৭ জুন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো ডলারের দাম নিচ্ছে। লুটের মালের মতো ব্যাংকগুলো যেভাবে পারছে সেভাবে ডলারের দাম নিচ্ছে। বর্তমানে এক ডলারের বিপরীতে ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত দাম নেয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে পোশাক রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দেশটি তৈরী পোশাক আমদানি ২২ শতাংশ। এতে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি ১৮ শতাংশ কমে গেছে। তৈরী পোশাক আমদানির যে পরিসংখ্যান যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে, তা বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের কপালে ভাঁজ ফেলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ এককভাবে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। গত বছর সেখানে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের পোশাক রফতানি করেছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রায় শেষ পর্যায়ে ২০২২ সালে ওই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জানুয়ারি-এপ্রিল এই চার মাসে বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের রফতানি হয়েছে ২৭০ কোটি ডলারের। ঠিক এক বছর আগে একই সময়ে রফতানি ছিল ৩২৮ কোটি ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে রফতানি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। পোশাক রফতানি কমে যাওয়ায় সামগ্রিক রফতানি আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। কারণ রফতানি আয়ের ৮৬ শতাংশই অবদান হলো এ পোশাক খাতের।

এ দিকে আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় পরিশোধের চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশী জ্বালানি সরবরাহকারীদের কাছে তরল গ্যাস এবং জ্বালানি তেলের বিল বাবদ পেট্রোবাংলা এবং বিপিসির যৌথ বকেয়া প্রায় ৭০ কোটি ডলার, যা অচিরেই পরিশোধ করতে হবে। ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে ইতোমধ্যেই কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এই অর্থের একটি অংশ বকেয়া রয়েছে ৬ মাস ধরে। এরই মধ্যে গ্যাস, তরল গ্যাস (এলএনজি) ও পরিশোধিত জ্বালানি সরবরাহকারী কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি জানিয়েছে, বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তারা আর জ্বালানি সরবরাহ করবে না। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, টাকার কোনো অভাব নেই। কিন্তু বিদেশী মুদ্রার সঙ্কটের কারণেই বিপিসির সাপ্লাইয়ারদের বকেয়া পরিশোধ করতে কিছুটা অতিরিক্ত সময় লাগছে। এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সময়মতো বিল পরিশোধ করতে না পারায় কয়েকটি বাংলাদেশী ব্যাংকের খোলা এলসিতে কনফারমেশন দিচ্ছে না কিছু বিদেশী ব্যাংক। বিশেষ করে দুবাইভিত্তিক মাশরেক ব্যাংক এবং রাকব্যাংক কনফারমেশন প্রদানে আপত্তি করছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোও এখন এই জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জরুরি জ্বালানি প্রয়োজন মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি না করে স্বতন্ত্র কোম্পানিগুলোকে ঋণের মাধ্যমে ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের কয়লা আমদানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে বার্ষিক এই সীমা ছিল ০.৫ মিলিয়ন ডলার।

সবমিলেই সামনে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বেড়ে যাবে। এতে সামগ্রিক বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে। ঘাটতি বেড়ে গেলে ডলার সঙ্কট হবে। আর ডলার সঙ্কট হলে টাকার মূল্য কমে যাবে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এতে জনদুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/754814