১২ জুন ২০২৩, সোমবার, ৩:৫৫

ডিজিটাল মামলায় বাড়ছে আতঙ্ক

চার বছরে ২২৩ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ১১০ মামলায় গ্রেফতার ৫৪

সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২৩ সালের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের শুরুতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ডিজিটাল আইনের ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার ও হয়রানির আশঙ্কা ততই বাড়ছে বলে অভিযোগ ওঠছে। বিশেষ করে মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য এই আইনটি কন্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘ভিন্নমত দমন,গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গভীর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া, দীর্ঘসময় গুম করে রাখার পর মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো, এমনকি গ্রেফতারের পর হেফাজতে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ সুশীল সমাজের। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এই আইনটি বাতিল করার দাবি ওঠলেও তাতে কান দেয়নি সরকার। সাংবাদিক, সুশীল সমাজ সেইসঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়েছিল; সেটার অপপ্রয়োগের অভিযোগ আবার নতুন করে সামনে এসেছে। সর্বশেষ প্রথম আলোর সাংবাদিক গ্রেফতার, সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা ও নওগাঁয় ভূমি কর্মচারী র‌্যাবের হাতে আটক নারীর মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে এই আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই আইনের খসড়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তখন আইনের সুনির্দিষ্ট আটটি ধারা নিয়ে কথা বলে তা সংশোধনের জন্য লিখিত প্রস্তাব করা হয়। নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীরাও আইনটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরে বাতিলেরও দাবি করেন। আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংশোধনের কথা বলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘এই আইনের কোনো অপপ্রয়োগ হবে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হলেও তদন্ত না করে তাদের গ্রেফতার করা যাবে না। আর সাংবাদিকরা অন্যায়ভাবে এই আইনের শিকার হলে আমি নিজে আইনি সহায়তা দেবো।
মানবাধিকার সংস্থা ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা ৮ মামলায় অন্তত ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২৭ জনই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতাকর্মী। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সুলতানা কামালের সই করা প্রতিবেদনটি গত বুধবার প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিও জানানো হয়। ১৮টি গণমাধ্যমের সংবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে এবং মানবাধিকার কর্মীদের মাধ্যমে যাচাই করার পর তা প্রকাশিত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছদ্মবেশে অপহরণ, ভূতুড়ে মামলা, বেআইনি গ্রেফতার ও আটক অবস্থায় নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট, শেয়ার ও মন্তব্যের মাধ্যমে দেশ ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬টি মামলা করা হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের হিসাবে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সারা দেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময়ে সব মিলিয়ে ৫৭৩টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৪০৪ জনকে। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) প্রকাশিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বিষয়ে গবেষণায় আইনটির ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫-এ চার ধারার সর্বাধিক ব্যবহার দেখা যায়। সিজিএসের হিসাবে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এ আইনের অধীন ১ হাজার ২৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৪৪ জন এবং তার মধ্যে ১ হাজার ৩৭৮ জন গ্রেফতার হয়েছিলেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের অনেকে জামিনে মুক্ত হলেও অনেকেই বিচারাধীন অবস্থায় আটক আছেন।

বাতিলের দাবি : 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় কেউ নিরাপদ নয়’ দাবি করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, ‘২০১৮ সালের অক্টোবরে এই আইন হলো, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৪টি মামলা হলো। ২০১৯ সালে ৬৩, ২০২০ সালে ১৯৭, ২০২১ সালে ২৩৮, ২০২২ সালে ১২২টি মামলা হয়েছে। ২০২৩ সালে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি মামলা হয়েছে।' অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেকগুলো ধারা জনগণের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী এবং এর সঙ্গে আইনটির যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং সর্বোপরি জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে গত এপ্রিলে এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন কোনো সমাধান নয়। আইনটি পুরোপুরি বাতিল করে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে শুধুমাত্র ডিজিটাল পরিকাঠামোর নিরাপত্তার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে সংবিধান পরিপন্থী প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ তথা আপামর জনগণের জন্য আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা আইনটি অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণকারী ও ভিন্নমতাবলম্বীর শায়েস্তাকারী এই আইন স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাংশ আইন লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে’ দাবি করে টিআইবি বলেছে, ‘ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, গভীর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া, দীর্ঘসময় গুম করে রাখার পর মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো, এমনকি গ্রেফতারের পর হেফাজতে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত করতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।’

সংশোধন করা হবে, আইনমন্ত্রী : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী পীড়নমূলক বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে না। তবে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমন কিছু সংশোধন আনা হবে। আগামী সেপ্টেম্বরে এটি সংশোধন করা হবে।’ আইনমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের টেকনিক্যাল নোটের ভিত্তিতে আগামী সেপ্টেম্বরের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’ আনা হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের একটা টেকনিক্যাল (কারিগরি) নোট পাঠানো হয়েছে। আমরা সেটা নিয়ে কাজ করছি, তাদের কিছু ধারা বাদ দেওয়া এবং সংশোধনের বিষয়ে পরামর্শ ছিল। যদিও আমাদের মতভেদ রয়েছে। আমরা বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই, অক্টোবরের পরে নয়। আমরা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংশোধনীটা করব।

৭ হাজার মামলা : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে এই আইনে ৭ হাজার ১টি মামলা হয়েছে। সে হিসাবে, প্রতিদিন গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪টি। ৫ মে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য দেন আইনমন্ত্রী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাস হয় এবং ওই বছরের অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। ওই সংসদ সদস্য ডিজিটাল মামলা আইনে মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যা জানতে চান। উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ পর্যন্ত কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে সংক্রান্ত প্রশ্নের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সংশ্লিষ্টতা থাকায় উক্ত অংশ সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ এর অনুচ্ছেদ ২১৩(২) অনুযায়ী জননিরাপত্তা বিভাগে স্থানান্তর করা হয়েছে। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অধস্তন আদালতগুলো চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৭০ হাজার ৬৭০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৬০টি এবং ফৌজদারি মামলা ২০ লাখ ৮৬ হাজার ৫১০টি। তিনি জানান, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩ মামলা চলমান রয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ২ লাখ ৭১ হাজার ৬০৬ মামলা চলমান। সর্বনিম্ন খাগড়াছড়িতে ৬ হাজার ৬৩০ মামলা চলমান রয়েছে।

https://dailysangram.info/post/527227