৬ জুন ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:০০

৩ বছরের কাজ : টেন্ডার ডিজাইনেই গেল ৭ বছর

ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন প্রকল্প

সমস্যার জাল, প্রকল্প পরিকল্পনায় অদক্ষতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে খরচ ও মেয়াদ বাড়ছে। অনুমোদনের পর প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ ঝিমিয়ে যায় বাস্তবায়নকারী সংস্থার রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ করার কথা ছিল। এটির মেয়াদ ৬ দফায় বেড়ে তিন বছর থেকে এখন ১৫ বছরে। আর খরচ ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে ২৯৫ শতাংশ বেড়ে এখন ৩ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকায় উন্নীত। প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়ার সাথে গতকাল বলেন, ২০১২ সালে অনুমোদন হলেও প্রকল্পের বাস্তব কাজ শুরু হয়েছে ৭ বছর পর ২০১৯ সালে। আর এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে এই প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত। ২০২৪ সালের জুনের আগে বনানী টু কমলাপুর লাইনের কাজ শুরু করতে পারবো না, শুধু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য আজ আবার সংশোধিত ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে একনেকে যাচ্ছে প্রকল্পটি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন রেল নির্মাণের জন্য ভারতীয় ঋণে ২০১২ সালের জুনে অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি তিন বছরে ২০১৫ সালের জুনে শেষ হবে। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা-টঙ্গী এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনের লাইন ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করে সব মেজর করিডোরে অধিক সংখ্যক ইন্টারসিটি ট্রেন, মালবাহী ট্রেন ও কনটেইনার ট্রেন পরিচালনা, দৈনিক যাত্রীদের জন্য কমিউটার বা সিটি ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নগর পরিবহন উন্নত করা, লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ট্রেন ভেদে যাত্রাসময় ২০ মিনিট হতে দেড় ঘণ্টা হ্রাস করা, ৪টি রেলওয়ে স্টেশনে উন্নততর যাত্রী সুবিধাদি প্রদান এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা।

প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো ছিল- ১০৭.৯৪ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ মেইন লাইন নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, ৬০ কেজি রেল দ্বারা ৩০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ লুপলাইন বা সাইডিং নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, ২টি মেজর সেতু এবং ২২টি মাইনর সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ, তেজগাঁও, বনানী, টঙ্গী ও ধীরাশ্রম স্টেশন ভবন পুনঃনির্মাণ এবং ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের ভার্টিক্যাল বর্ধিতকরণ করা। এ ছাড়া ১৪টি প্লাটফর্ম নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ, ৪টি প্লাটফর্ম বাড়ানো, ৯টি প্লাটফর্ম শেড নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ ও ৩টি প্লাটফর্ম শেড বর্ধিতকরণ, এপ্রোচ সড়ক, ড্রেন, অফিস ও আবাসিক ভবন নির্মাণ বা পুনঃনির্মাণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ, এক্সেস কন্ট্রোল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে লাইটিংসহ রেলভূমির সীমানা প্রাচীর বা বেড়া নির্মাণ করা। টেলিকমিউনিকেশনসহ ৭টি স্টেশনে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলকিং (সিবিআই) সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন ও সিটিসির সাথে ইন্টারফেসিং, ৩৭টি লেভেল ক্রসিং গেটে সিগন্যাল ওয়ার্নিং সিস্টেম স্থাপন এবং ডিজাইন, দরপত্র সেবা, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন এবং ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডে পরামর্শক সেবা ক্রয়।

মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠিকাদারের কাজের ধীরগতি, কোভিড-১৯ জনিত সমস্যায় বাধাগ্রস্ত, বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায় বেসামরিক বিমান চলাচাল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এর জমি হস্তান্তর, ডিওএইচএস এলাকায় ভূমি জটিলতা, এফডিইইর সাথে সমন্বয়, অবৈধ স্থাপনা অপসারণ, খিলগাঁও-মালিবাগ সেকশনে বিদ্যমান রাস্তা স্থানান্তরের কারণেই প্রকল্পের এই মন্থর গতি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ওপর নির্ভর করছে এই প্রকল্পটির সমাপ্তি। বিমানবন্দর পর্যন্ত কাজের অবস্থা চলমান এবং ভালোভাবেই গতিশীল। তবে বনানীর পর থেকে কাজের জায়গা ক্লিয়ার না পাওয়ায় কমলাপুর পর্যন্ত বাস্তবায়ন কাজ আগানো সম্ভব হচ্ছে না। ক্লিয়ার পেলেই আমরা দ্রুত গতিতে কাজ করে যাবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর নির্ভর করছে রেলের এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের সার্বিক পরিস্থিতি বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর অংশের কাজ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদারের কারণে তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। টিকাদার প্রকল্পের নির্মাণ সাইটে মালামাল, পিওয়ে ফিটিংস, পাথর ও স্লিপারসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী সময় মতো সরবরাহ করতে পারেনি। তাই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। তা ছাড়া কোভিড-১৯ জনিত কারণে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনবল এবং মালামাল আসতে না পারাতে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতিতে বিঘœতা সৃষ্টি হয়।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে এসে ব্যয় ১ হাজার ১০৬ কোটি ৮০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়। এই খরচের মধ্যে প্রকল্প ঋণ ৯০২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর বাস্তবায়নকাল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নেয়া হয়। কিন্তু তাতেও প্রকল্পের কাজে কোনো প্রত্যাশিত গতি নেই। এখন প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৪২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর প্রকল্প সমাপ্তির মেয়াদ ২০২৭ সালের জুুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা বিমানবন্দর সেকশনে বিদ্যমান রেললাইনের উভয় পাশে অবৈধ স্থাপনা প্রকল্পের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এখানে অন্যান্য সংস্থার বিভিন্ন ধরনের সেবা বিশেষ করে, ড্রেন, রাস্তা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি বিদ্যমান থাকায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। অন্য দিকে, খিলগাঁও থেকে মালিবাগ সেকশনের মালিবাগ রেল ক্রসিং পর্যন্ত অংশে তৃতীয় ও চতুর্থ রেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে তৃতীয় লাইনের জন্য প্রস্তাবিত জুমতে বিদ্যমান আপ লাইনের দক্ষিণ পাশ বরাবর রেল ভূমিতে সমান্তরালভাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি রাস্তা নির্মিত আছে। যার কারণে ওই অংশের কাজ বাস্তবায়নে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়ার সাথে গতকাল তার মুঠোফোনে প্রকল্পের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, চলতি বছরের মে পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে প্রকল্পের অগ্রগতি নির্ভর করছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির ওপর।

তিন বছরের কাজ এখন ১৫ বছরে যাচ্ছে কেন জানতে চাইলে পিডি কেয়া বলেন, না না, কাজ এতো বছর লাগেনি। মূলত কাজ শুরু হয়েছে ২০১৯ সাল থেকে। তার আগে টেন্ডার, টেন্ডার প্রক্রিয়া এবং ডিজাইন করতেই সময় চলে গেছে। অনুমোদন ২০১২ সালে হলেই তো কাজ শুরু করা যায়নি। ২০১৯ সালে এসে ফিজিক্যাল কাজ শুরু করা সম্ভব হয়েছে। আগের সাত বছর কোনো কাজ হয়নি। টেন্ডার, রিটেন্ডার, ডিটেইল ডিজাইন এগুলো করতেই সময় গেছে। তিনি বলেন, আগামী ২০২৭ সালের জুনে শেষ হবে কি না সেটা নির্ভর করছে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের ওপর। তাদের প্রকল্পের কারণে বনানী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আমরা কাজ করতে পারছি না। তারা তাদের কাজ শেষ করে আমাদের কাছে সাইড হস্তান্তর করবে। তার পর আমরা কাজ শুরু করতে পারবো। তিনি বলেন, বনানী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত চার লেনের মোট ৩৭ কিলোমিটার রাস্তা আমরা কাজ করতে পারবো না এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কারণে।

নাজনীন আরা কেয়া জানান, তারা (এলিভেটেড প্রকল্প) বলছে, আগামী ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে আমাদের কাছে সাইড হস্তান্তর করবে। তারা হস্তান্তর করার পর আমরা তৃতীয়, চতুর্থ লাইন করে সেখানে ট্রেন চালিয়ে দিয়ে তারপর এক্সিটিং লাইনের কাজ করতে পারবো। আমরা আশা করছি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ফিজিক্যাল কাজ শেষ করতে পারবো। যদি তারা তাদের প্রতিশ্রুত সময়ে সাইড দিয়ে দেয়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর এবং তাদের কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো সময় মতো শেষ হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে সময় বাড়লে ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, ভালো কাজের জন্য কোনো পুরস্কার এবং খারাপ কাজ বা কাজের অবহেলার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার কারণেই এমনটা হচ্ছে। দেশের মানুষও সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/753356