১৭ মে ২০২৩, বুধবার, ৩:০৭

সরেজমিন সেন্টমার্টিন

নিজ ভূমিতে হাজারো মানুষ উদ্বাস্তু

হাতে ত্রাণের প্যাকেট। সামিনা আক্তার গোমড়া মুখে বসে ছিলেন ৬ নম্বর সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে। কোলে পাঁচ মাসের সন্তান রাফিসা, পাশেই আরেক মেয়ে মোহনা। ত্রাণ পেয়েও চেহারায় কেন কালো মেঘ– এমন প্রশ্নে সামিনা বললেন, ‘সেন্টমার্টিনের পূর্বপাড়ায় আমার ভিটে। ঝড়ে পুরো ঘর লন্ডভন্ড। তিন দিন ধরে প্রতিবেশী আলমগীরের বাড়িতে পুরো সংসার নিয়ে ঠাঁই নিয়েছি। তাঁর ঘরেই টুকটাক যা রান্না হয় সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে বেঁচে আছি।’

সামিনা আরও জানান, ঘর ঠিক করার মতো অবস্থা তাঁর নেই। ঝড়ের আগে ট্রলার নিয়ে টেকনাফ যাওয়ার পর সেন্টমার্টিনে এখনও ফেরত আসেননি স্বামী নূর আলম। গতকাল মঙ্গলবার সকালে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছে সামিনার। তাঁর ফিরতে লাগবে আরও ক’দিন।

প্রবাল দ্বীপটিতে যাঁরা স্থায়ীভাবে বাস করছেন, তাঁদের অধিকাংশের ঘরের কাঠামো দুর্বল হওয়ায় মোকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি ভেঙে গেছে অনেকের ঘর। কারও ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় আংশিক।
.
গতকালও নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, জেলা প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিনের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে দ্বীপটির সঙ্গে জলপথে স্থানীয়দের যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি। এখনও দ্বীপের কোথাও বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান সমকালকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে টিন ও নগদ অর্থ সহায়তা দিতে আমরা প্রস্তুত। মঙ্গলবারও সমুদ্র উত্তাল ছিল। বেসরকারি মালিকানাধীন ট্রলার ও নৌকায় আমরা সেন্টমার্টিনে মালপত্র পাঠিয়ে থাকি। একটু স্বাভাবিক হলেই সেখানে ত্রাণের টিন পাঠানো হবে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একেকটি পরিবারকে দুই বান্ডেল টিন ও নগদ ৩ হাজার করে টাকা দেওয়া হবে। দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৭৫ শতাংশ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত
৯ ওয়ার্ড নিয়ে সেন্টমার্টিন। দ্বীপে প্রায় ১০ হাজার লোকের বাস। আয়ের প্রধান উৎস সমুদ্রে মাছ শিকার ও পর্যটন। তবে এখন ৬৫ দিনের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মাছ ধরা বন্ধ, পর্যটকদের উপস্থিতি নেই; তার ওপর আঘাত হেনেছে মোকা। এ কারণে রয়েছে কর্মসংস্থানের সংকট। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য খোরশেদ আলম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের যে কয়েকটি ওয়ার্ড সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে, এর মধ্যে তাঁর ওয়ার্ড একটি। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে স্থায়ী বাসিন্দা ১ হাজার ৮০০’র বেশি। অস্থায়ী বাসিন্দা মিলিয়ে সেই ওয়ার্ডে প্রায় আড়াই হাজার লোকের বাস। এখানকার ৭৫ শতাংশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খোরশেদ বলেন, এলাকায় দ্বীপের একটি অংশ ভেঙে গেছে। সমুদ্রসৈকত থেকে অনেকে অবৈধভাবে বালু ও পাথর তুলে হোটেলের ভেতরে নিয়ে আসছেন। এভাবে দ্বীপটির ক্ষতি করে যাচ্ছেন। ঝড়ে যাদের বাড়িঘর উড়ে গেছে, তাঁদের জন্য আগে থাকার ব্যবস্থা করাটা জরুরি। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেলে তাঁরা কতদিন নিজ এলাকায় পরবাসী হয়ে থাকবেন। ত্রাণও দরকার, তবে এর পাশাপাশি দ্রুত টিন, ত্রিপল ও ঘর তৈরির বাঁশের ব্যবস্থা করতে হবে। ইউপি সদস্য আরও বলেন, পুরো দ্বীপে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ। ঝড়ের সময় হাসপাতাল, হোটেল ও জেলা পরিষদকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে দ্বীপবাসীকে তোলা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা জসীম উদ্দিন বলেন, এখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট রয়েছে। রাঘববোয়ালদের হাত থেকে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ বাঁচাতে হবে। অনেকে কেওড়ার বন কেটে সাবাড় করছেন। মোকায় সেন্টমার্টিনের দুই-তিনটি পয়েন্টে ভাঙন ধরেছে। এ ছাড়া সেন্টমার্টিনে ১২শ’র বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। কমবেশি ক্ষতি হয় দ্বীপের অধিকাংশ ঘরবাড়ির।

সেন্টমার্টিনের কোনাপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক জানান, ঝড়ের রাতে পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। এখনও ভালোভাবে হাঁটতে পারছেন না। তাঁর ঘর ভেঙে গেছে। দ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার ত্রাণের লাইনে অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন । তিনি জানান, দক্ষিণ পাড়ায় তাঁর বাড়ি। ঝড়ে ঘর উড়ে যাওয়ার পর থেকে ভাই ইসমাইলের বাড়িতে আশ্রয় নেন।

গতকাল সেন্টমার্টিন পরিদর্শনে যান কোস্টগার্ডের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন সোহেল আজম। তিনি বলেন, ঝড়ের আগে দ্বীপবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কাজটি সমন্বয় করেছিল কোস্টগার্ড। ঝড়ে দ্বীপের উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়াসহ কিছু এলাকায় ক্ষতি হয়েছে। আরও কয়েক দিন গেলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ৬৫ দিনের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরা বন্ধ রাখার বিষয়টি জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেলেরা বেশি কষ্টে থাকলে দ্বীপের আশপাশে টুকটাক মাছ ধরতে পারে। টেকনাফের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরও দু-একদিন লাগতে পারে।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান সেন্টমার্টিনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। বিজিবির পক্ষ থেকে ৮০০ জনকে ত্রাণ দেওয়া হয়।

নৌবাহিনীর পক্ষ থেকেও সেন্টমার্টিনে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। নৌবাহিনীর জাহাজ বি এন এস সমুদ্র জয়ের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মিজানুর রহমান বলেন, ত্রাণের প্রতিটি প্যাকেটে পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, এক কেজি ছোলা, ময়দা, সয়াবিন তেল, লবণ, সুজিসহ নানা সামগ্রী রয়েছে। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে।

https://samakal.com/whole-country/article/2305172965