১৬ মে ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:০১

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় সেন্টমার্টিনের মানুষ

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পূর্ব পাশের জেটি ঘাট দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই মূল বাজার। যে বাজারে প্রবেশ করতেই দেখা মিলে ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষত। অনুমানিক সাড়ে ৩০০ দোকান নিয়ে বাজারটির পাকা দোকানগুলো অক্ষত থাকলেও আধা পাকা এবং টিন শেড দোকানের ছাউনি উপড়ে গেছে। কিছু কিছু দোকান ভেঙে গেছে আংশিক।

সোমবার বিকেল ৫টার দিকে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিকরা কিছুটা ভাঙা অংশ সংস্কারে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বাজারের কয়েকটি দোকানও খুলেছে। যে দোকান ঘিরে মানুষের আনাগোনা বলে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় মালামাল বা উপকরণ কিনছেন দ্বীপের মানুষ।

বাজারের ব্যবসায়ী নাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, তার মুদির দোকানের অর্ধেক অংশ ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে টিন। যা মালামাল ছিল তাও বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। যা আছে তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। অপর ব্যবসায়ী আবদুল মালেক জানিয়েছেন, বাজারের কম হলেও দেড় শতাধিক দোকান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটির বাজার হয়ে পশ্চিম পাড়ার সড়কটির বিভিন্ন পয়েন্ট জুড়ে রয়েছে গাছ ভেঙে যাওয়ার অস্তিত্ব। যদিও এর মধ্যে সড়ক থেকে গাছ কেটে চলাচল উপযোগী করা হয়েছে। তবে সড়কের দুই পাশে অবস্থিত আধা পাকা ঘর, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, ছোট্ট মানের কটেজ আংশিক বা সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য দেখা মিলে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সদস্য (মেম্বার) খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবকরা মিলে সড়কে ভেঙে যাওয়া গাছ সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দ্বীপে এসে সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। বিকেল ৫টায় ঊর্ধ্বতন দলটি দ্বীপ থেকে টেকনাফের উদ্দেশে যাত্রা দিয়েছে। দ্বীপের সার্বিক চিত্র তারা দেখেছেন, ক্ষয়-ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণও তাদের জানানো হয়েছে।

এই জনপ্রতিনিধি জানান, দ্বীপের পশ্চিম পাড়া, উত্তর পাড়া, কোনার পাড়া, গলাচিপা, মাঝের পাড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার মানুষ এখনও খোলা আকাশের নিচে রয়েছে।

পশ্চিম পাড়া এলাকার রফিকুল হুদা নামের এক জেলে জানান, সাগরে মাছ ধরে জীবিকা পরিচালনা করেন তিনি। স্ত্রী, ৩ সন্তান নিয়ে সংসার। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলেন। ফিরে এসে দেখেন ঘরটি ভেঙে গেছে।

কোনার পাড়া এলাকার হেলাল উদ্দিন নামের এক যুবক জানান, পুরো দ্বীপ এখন শ্রীহীন হয়ে উঠেছে। আগের অবস্থায় ফিরতে আরো অনেক সময় লাগবে।

কোনার পাড়ার কটেজ মালিক আবু তালেব জানান, ১০ কক্ষের কটেজের টিন উড়ে গেছে। একটি অংশ ভেঙে গেছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান জানান, দ্বীপের ১২০০ ঘর ও কটেজ ভেঙে গেছে। তার মধ্যে ১ হাজার বসত ঘর। এসব ঘরের মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে রয়েছে। জেলা প্রশাসক সোমবার দ্বীপ পরিদর্শনে এসে শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন। একই সঙ্গে প্রশাসনের সহযোগিতায় ইউনিয়নের পক্ষে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

তিনি জানান, দ্বীপের ২ হাজারের বেশি গাছ ভেঙে গেছে। এর মধ্যে সড়কের গাছ পরিষ্কার করে চলাচল উপযোগী করা হয়েছে।
বিকেল ৫টার পর পর জেটি ঘাটে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে দ্বীপের মানুষকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মঙ্গলবারের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত হবে। মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ে মূল আঘাত হয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। এর বাইরে টেকনাফ উপজেলায় কিছু ক্ষতি হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ১ হাজার ঘর, টেকনাফের অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় ৩ হাজার ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখায় জেলায় ১০ হাজার কাঁচা বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ২ হাজার ঘর বাড়ি। শুধু সেন্টমার্টিন দ্বীপের ১২০০ কাঁচা বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়ো হাওয়ায় সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সাবরাং এলাকায় গাছ পালা উপড়ে যায়। তবে মোখায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। জেলা প্রশাসক আরো জানান এটি একেবারেই প্রাথমিক হিসাব।

ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের ঘর বাড়ি ছাড়াও বেশ কয়েকটি মসজিদ ও হোটেল রিসোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু কিছু কাঁচা ও আধা পাকা ঘর বাড়ি একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে।

কক্সবাজার জেলার উপকূল এলাকায় ৬৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব কমে যাওয়ায় আশ্রয় নেয়া অধিকাংশই গতকাল তাদের বাড়ি ঘরে ফিরে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দারা আজ সকালে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে গেছে।

সাগর এখনো উত্তাল থাকায় সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের সাথে এখনো নৌ যোগাযোগ শুরু হয়নি। সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন পানীয়জল খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কায় স্থানীয়রা।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাশন কার্যালয় সূত্রে জানা যায় ঘূর্ণিঝড় মোখায় উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৫ শতাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ইতোমধ্যে মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
মহেশখালীতে মোখায় ৩ লবণ চাষির মৃত্যু : রোহিঙ্গাদের ২৮০০ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত
কক্সবাজার অফিস, মহেশখালী ও উখিয়া সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় তাণ্ডব চালানোর সময় মহেশখালী দ্বীপের চাষিরা ঝড়ের কবল থেকে ঘেরের লবণ বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। ওই সময় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তিন লবণ চাষির মৃত্যু ঘটেছে। তবে ঘটনাটি স্থানীয়রা জানতে পারেন গত রোববার সন্ধ্যার পর।

নিহতরা হলেন, উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজীর পাড়া গ্রামের আবুল ফজলের ছেলে রিদোয়ান (৩৫), পানিরছড়া গ্রামের আকতার কবিরের ছেলে মুহাম্মদ নেছার (৩২) ও পানিরছড়া বারঘর পাড়ার মৃত মতিনের ছেলে মো: আনছার। হোয়ানক ইউপির চেয়ারম্যান মীর কাশেম চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, রোববার সকাল ১০টায় মাঠে পলিথিন ও লবণ উঠানোর জন্য ৪০-৫০ জন শ্রমিক মাঠে যায়। বৃষ্টির মধ্যে কাজ করার কারণে ঠাণ্ডায় ৬/৭ জন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৬টার দিকে রিদওয়ানকে (৩৫) কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন আর বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

অন্যদিকে লবণ মাঠে পলিথিন উঠাতে গিয়ে মারা যান মুহাম্মদ নেছার নামের আরেকজন। তাকে রাত সাড়ে ১০টায় পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সময় সোনা মিয়া নামের আরেক কৃষককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তিনি মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া এলাকাবাসী রাত সাড়ে ১১টায় লবণ মাঠ থেকে আনছারের লাশ উদ্ধার করে। স্থানীয়রা জানায়, হোয়ানকের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আরো ১০/১৫ জন লবণ চাষি এখনো ঘরে ফিরেনি।

মহেশখালী হাসপাতালের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: মাহফুজুল হক জানান, চাষিরা মোখার প্রভাবে ঠাণ্ডাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ ইয়াসিন তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু ও কয়েকজন অসুস্থ হওয়ার কথা শুনেছেন বলে জানান।

৭ রোহিঙ্গা আহত : মোখার আঘাতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২ হাজার ৮২৬টি ঘর ছাড়াও লানিং শেল্টার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়ে ৭ রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। কক্সবাজারস্থ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।

কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোখার আঘাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১৭৮টি ঘর সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৪৮টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্যাম্পের ৩২টি লার্নিং শেল্টার, ১টি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, ২৯টি মসজিদ ও মক্তব, ১৮৩টি টয়লেট, ৩২টি গোসলখানা, ২০টি নলকূপ, ১৩৫ ফুট রাস্তা, ৫৮টি অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোখার সময় ১২০ স্থানে ভূমিধস, ২২৬টি গাছ উপড়ে পড়েছে। এ সময় ৭ রোহিঙ্গা আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত হন ১ হাজার ৬১১ জন। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরসহ অন্যান্য স্থাপনা দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কারের চেষ্টা চলছে।

অল্পতে রক্ষায় খুশি রোহিঙ্গারা : পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস রোহিঙ্গাদের। মোখার তাণ্ডবে প্রাণহানির আশঙ্কায় ছিলেন তারা। ঘূর্ণিঝড়ের খবর শোনার পর থেকে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন যেন নিরাপদে থাকতে পারেন। বালুখালী ময়নাঘোনা ১১ নং ক্যাম্পের নুরে জান্নাত বলেন, আমরা ভালো আছি। তবে বিভিন্ন ক্যাম্পে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি-ঘর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ সবাই খুব ভয়ের মধ্যে ছিল। তবে আল্লাহ মজলুমের দোয়া কবুল করেছেন। এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে, জেলায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার আংশিক ও ২ হাজার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। শুধু সেন্টমার্টিনেই ১২০০ ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। উপড়ে পড়েছে বহু গাছপালা। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ঘর।
বরিশালে লঞ্চ চলাচল শুরু

বরিশাল ব্যুরো জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কেটে যাওয়ায় তিন দিন বন্ধ থাকার পর বরিশালে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টায় এ তথ্য জানান, বিআইডব্লিউটিএ’র বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি জানান, সোমবার সকাল ৯টা থেকে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মাসুদ রানা রুবেল জানান, বরিশাল ও পটুয়াখালী নদী বন্দরকে সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত এক নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সমুদ্র বন্দরগুলোতে কোনো সঙ্কেত নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/748295