১৬ মে ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৫২

পথের দু’ধারে ফলদ বৃক্ষ কেন নয়

-ইকতেদার আহমেদ

পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষ সকালের নাশতা ও দু’বেলা আহারের পর ফল বা ফলের রস খেতে অভ্যস্ত। এমন অনেক দেশ আছে যেসব দেশে জনগণের চাহিদার তুলনায় ফলের উৎপাদন কম। সে সব দেশ ফলের চাহিদা মেটাতে আমদানির ওপর নির্ভর করে থাকে। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যেসব ফল উপযোগী; প্রাকৃতিকভাবে সেসব ফল ওই অঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে থাকে। এর জন্য বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। উন্নত ও ধনী রাষ্ট্রগুলোতে জনসাধারণের চাহিদা ও পছন্দের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেসব ফল সেসব দেশে উৎপন্ন হয় না তা আমদানির ব্যবস্থা করা হয়। পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পৃথিবীর সর্বত্র চিকিৎসকরা প্রত্যেক মানুষকে দৈনিক ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

অনুন্নত ও গরিব দেশের জনগণ তাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দৈনিক যে পরিমাণ ফল খাওয়া আবশ্যক তা খেতে পারেন না। এমন অনেক অনুন্নত ও গরিব রাষ্ট্র রয়েছে যেসব দেশে অভ্যন্তরীণ ফলের উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানির মাধ্যমে চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদন হয়। তবু প্রতি বছর বিপুল ফল আমদানি করা হয়। এসব ফলের মধ্যে অন্যতম- আপেল, আঙ্গুর, আনার, কমলা, মাল্টা, খেজুর, আম প্রভৃতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব ফল উৎপন্ন হয় এর মধ্যে অন্যতম হলো- আম, জাম, কাঁঠাল, কমলা, আনারস, পেয়ারা, নারকেল, বেল, আমড়া, লটকন, সফেদা, আতা, আমলকী, জলপাই, জামরুল, কুল, গোলাপজাম, লিচু, দেশীয় খেজুর, পেঁপে, তরমুজ, বাঙ্গি, স্ট্রবেরি প্রভৃতি। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ফলের মধ্যে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে সীমিত আকারে কাঁঠাল, আনারস ও লটকন রফতানি হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কৃষিতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। এখন কোনো একটি বিশেষ ফল কোনো একটি দেশে এককভাবে উৎপাদন হয়- এ কথা বলার দিন শেষ হয়ে গেছে। আজ থেকে ১০ বছর আগেও দক্ষিণ আমেরিকার ফল স্ট্রবেরি আমদানিতে বাংলাদেশ বিপুল অর্থ ব্যয় করত। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা সয়েল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দেশে উন্নত জাতের স্ট্রবেরি উৎপাদনে সফল হয়েছেন। বর্তমানে স্ট্রবেরি উৎপাদনে বাংলাদেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; অচিরে যে রফতানিতে সক্ষম হবে সেটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সয়েল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে উৎপাদিত খেজুর, মালয়েশিয়ায় উৎপাদিত রামভুতুম ও ড্রাগন ফল, ইউরোপে উৎপাদিত আঙ্গুরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত নানা জাতের ফল উৎপন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে ফলসহ কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের ভূমি স্বল্প হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রধান কৃষিজ পণ্য ধান ও পাটের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে সেভাবে ফল উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পারছি না।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও বিভিন্ন নদ-নদীর দু’ধারে যে বাঁধ রয়েছে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে যে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ রয়েছে এসবের দু’ধারে পরিকল্পিতভাবে ফলদ ও বনজ বৃক্ষ লাগানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনভাবে কিছু স্থানে শুধু বনজ বৃক্ষ লাগানো হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার সাথে সংযোগ স্থাপনে যে বিস্তীর্ণ রেলপথ রয়েছে এর দু’পাশের ভূমিতে কোনো ধরনের বৃক্ষ নেই বললে চলে। এমন অনেক বৃক্ষ রয়েছে যেগুলো ডালপালাহীন ও সোজাসুজি ঊর্ধ্বমুখী যেমন- দেশীয় খেজুর, তাল, নারকেল প্রভৃতি। তা ছাড়া কিছু ফলদ বৃক্ষ রয়েছে যেগুলো মাঝারি আকৃতির এবং ডালপালাও বিস্তৃত হয় না যেমন- কমলা, পেয়ারা, সফেদা, আতা, শরিফা, গাব, লটকন প্রভৃতি। আমাদের বিস্তীর্ণ রেলপথের দু’পাশে এসব বৃক্ষ লাগিয়ে অনায়াসে ফলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের মানুষের জন্য ফলকে সুলভ করা যায়। একইসাথে এসব ফল রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জন বাড়াতে পারি। দেশে এক জেলার সাথে অন্য জেলার যোগাযোগ রক্ষায় যেসব মহাসড়ক ও সড়ক রয়েছে তার দু’ধারে বিভিন্ন ধরনের বনজ বৃক্ষ রয়েছে। বনজ বৃক্ষের মধ্যে ফলদ ও কাষ্ঠজ উভয় অন্তর্ভুক্ত। আমরা সচরাচর আমাদের মহাসড়ক ও সড়কের দু’ধারে যেসব বনজ বৃক্ষ দেখতে পাই তা কাষ্ঠজ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- কড়ই, বাবলা, শিশু, একাশিয়া, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি। এ সব বনজ বৃক্ষের কাঠের মান মধ্যম ও নিম্ন। ফলদ বৃক্ষের মধ্যে কাঁঠাল গাছের কাঠের মান উন্নত। কাঁঠাল গাছের কাঠ সেগুন বা মেহগনির সমপর্যায়ের না হলেও এর কাছাকাছি বললে অত্যুক্তি হবে না। কাঁঠাল গাছের এমন দু-একটি জাত রয়েছে যেগুলো মধ্যম আকৃতির এবং ডালপালা বিস্তৃত হয় না। আমরা কাঁঠালে স্বয়ংসম্পূূর্ণ হলেও প্রতি বছর চোরাই পথে ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে বিপুল কাঁঠালের বাংলাদেশে প্রবেশ ঘটে। আমাদের মহাসড়ক, সড়ক ও রেলপথের দু’ধারে কাঁঠাল গাছ লাগানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হলে দেশে শুধু ফলের উৎপাদন বাড়বে না; উন্নতমানের কাঠের জোগানও নিশ্চিত হবে। কাঁঠাল এমন একটি ফল যার কিছু ফেলনা নয়। আমাদের গৃহিণীরা কাঁঠাল খাওয়ার পর এর বীচি রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে থাকেন। পরবর্তীতে এটিকে রান্নায় তরকারি হিসেবে এবং ভর্তা বানাতে ব্যবহার করা হয়। কাঁঠালের মধ্যভাগের বোঁটা থেকে তলদেশ অবধি যে মুশলটি বিস্তৃত থাকে তা দিয়ে তরকারি রান্না করলে খুব উপাদেয় খাবার হয়। কাঁঠালের ছিলকা আমাদের গৃহপালিত পশু ও গরুর খুব প্রিয় খাবার।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে খেজুর উৎপন্ন হয় এ গাছগুলো মধ্যম আকৃতির। সৌদি আরবের বিভিন্ন সড়কের দু’পাশে এবং সড়কদ্বীপে খেজুর গাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এসব গাছ সে দেশের খেজুর উৎপাদন বৃদ্ধিতে যে সহায়তা করছে শুধু তাই নয়; বরং সড়কদ্বীপ ও সড়কের দু’ধারের শোভাও বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশেরও বেশ কিছু শৌখিন লোক নিজেদের বাড়ির আঙিনায় মধ্যপ্রাচ্যের খেজুর গাছ লাগিয়ে সফলতা পেয়েছেন। এসব খেজুর গাছ হতে মধ্যপ্রাচ্যে যে হারে খেজুর উৎপাদিত হয় এখানেও সে হারে খেজুর উৎপাদিত হচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন সড়কদ্বীপে, সড়কের দু’ধারে ও বাঁধের দু’ধারে এ ধরনের খেজুর গাছ লাগানোর সুযোগ রয়েছে।

দেশীয় খেজুর গাছ থেকে আমরা একাধারে রস ও ফল পেয়ে থাকি। খেজুরের রস একটি উত্তম স্বাস্থ্যকর পানীয়। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন প্রত্যুষে নাশতা পরবর্তী এক গ্লাস খেজুরের রস খেলে তা তার স্বাস্থ্যরক্ষায় সহায়ক হয়। খেজুরের রস দিয়ে যে গুড় তৈরি করা হয়, দেশে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। খেজুর গাছ আমাদের এতদঅঞ্চলের বিধায় এটি কোনো স্থানে লাগানোর পর খুব একটা পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের যে পরিমাণ খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে আমরা সে পরিমাণে উৎপাদনে অক্ষম বিধায় প্রথমোক্তটি শহরাঞ্চলে দুষ্প্রাপ্য এবং শেষোক্তটির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে। আমাদের বিভিন্ন বাঁধ, সড়ক ও রেলপথের দু’ধারে যদি পরিকল্পিতভাবে খেজুর গাছ লাগানো হয়; তাতে খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়ের ঘাটতি পূরণ হয়ে বেশ কিছু পরিমাণ রফতানির জন্য অবশিষ্ট থাকবে। সম্প্রতি দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুর সড়কদ্বীপে শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বিপুল খেজুর গাছ আমদানি করেছে। সিঙ্গাপুর পৃথিবীর একটি উন্নত রাষ্ট্র। নিজ দেশের সম্পদ বলতে তেমন কিছু নেই। শুধু মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটিয়ে আজ পৃথিবীর একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ। সিঙ্গাপুর যেভাবে আমাদের দেশীয় খেজুর গাছকে শোভাবর্ধনকারী বিবেচনায় সেখানকার সড়কদ্বীপে স্থান দিয়েছে, আমরা কি পারি না একই বিবেচনায় এবং এর পাশাপাশি রস, গুড় ও ফল উৎপাদনে সহায়ক- এ কথাগুলো ভেবে নিজ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছটি লাগিয়ে এর থেকে সব ধরনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে।
বর্তমানে আমাদের মহাসড়ক ও সড়কের দু’পাশে যে গাছটির আধিক্য পরিলক্ষিত হয় তা হলো কড়ই। এটি সুউচ্চ এবং এর ডালপালা চারদিকে বিস্তৃত। এ ধরনের একটি গাছ থেকে বিপুল কাঠ পাওয়া যায়-কথাটি সত্য কিন্তু এ ধরনের গাছ ও গাছের ডাল সড়কের ওপর বিস্তৃত হলে বৃষ্টি ও বৃষ্টি পরবর্তী অনেকক্ষণ সময় নিয়ে তা থেকে পানি ঝরে সড়কের ক্ষতিসাধন করে। এ গাছের যে উপযোগিতা এর চেয়ে বেশি আমরা কাঁঠাল বা অন্য কোনো ফলদ বৃক্ষ থেকে পেতে পরি। তবে কেন অযথা মহাসড়ক ও সড়কের দু’ধারে কড়ই গাছ লাগিয়ে সড়কের ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে?

আমাদের দেশের প্রতিটি উপজেলা বর্তমানে পাকা সড়ক দিয়ে জেলা শহরের সাথে সংযুক্ত। তা ছাড়া গ্রামাঞ্চলের অভ্যন্তরে যেসব সড়ক রয়েছে এর বেশ কিছু পাকা, কিছু কিছু ইট বিছানো এবং কিছু সম্পূর্ণ মেঠো। গ্রামাঞ্চলের সড়কগুলোর দু’ধারে ধানক্ষেত থাকায় এসব সড়কে ডালপালা বিস্তৃত বৃক্ষ লাগানো হলে ছায়ার কারণে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে- এ কথা মাথায় রেখে সচরাচর এসব সড়কে শুধু ডালপালা বিস্তৃত নয়; বরং কোনো বৃক্ষরোপণ করা হয় না। অথচ এসব সড়কে আমরা যদি খেজুর, তাল বা নারকেল গাছ রোপণ করি তাহলে ছায়ার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। খেজুরের রসের মতো তালের রসও উপাদেয় পানীয়। তালের সাহায্যে যে মিশ্রী উৎপন্ন হয় তা কাশি নিবারণে সহায়ক। নারকেল গাছ থেকে উৎপাদিত ডাবের পানি খনিজ উপাদানসমৃদ্ধ উৎকৃষ্ট পানীয়। নারকেল আমরা খাবার হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও এর তেল চুলের পরিচর্যাসহ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করি। দেশে নারকেলের ব্যাপক উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও আমরা সে সুযোগ কাজে লাগাচ্ছি না। নারকেল তেল রান্নায় ব্যবহার না হলেও কেশ পরিচর্যা ও অন্যান্য কারণে প্রতি বছর বিপুল নারকেল তেল আমদানি করতে হচ্ছে। বর্তমানে নারেকেলের এমন কয়েকটি জাত রয়েছে যে গাছগুলো মধ্যম আকৃতির চেয়ে নিম্নের। এ সব নারকেল গাছ আমরা বিভিন্ন ধরনের সড়ক ও বাঁধের দু’পাশে লাগিয়ে নিজেদের চাহিদার সম্পূর্ণ অংশ মেটাতে পারি।

পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের ফলের চাহিদা দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত ফল দিয়ে মেটানোর ব্যাপারে সচেষ্ট। এসব দেশের মধ্যে এমন দুয়েকটি রয়েছে যেগুলো নাগরিকদের চাহিদা ও পছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজ দেশে উৎপাদিত হয় না- এমন ফল উৎপাদনে সফলতা পেয়ে চাহিদার সম্পূর্ণ জোগান দিতে সমর্থ হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় ভূ-ভাগ সীমিত হলেও যে বাঁধ, সড়ক ও রেলপথ রয়েছে এগুলোর দু’ধারের বিস্তীর্ণ ভূমিতে আমরা কি পারি না দেশে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয় এমন সব বৃক্ষ এবং সয়েল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে আমদানি করা বিদেশী ফলের বৃক্ষ লাগিয়ে নিজেদের ফলের চাহিদার সম্পূর্ণ জোগান নিশ্চিত করতে?

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/748175