২৭ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৫:৪২

কী ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামে

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

মাস দুই আগে পত্রিকার প্রথম পৃষ্টার একটি সিঙ্গেল কলাম নিউজ ছাপা হয়েছিলো। নিউজটি হলো বান্দরবান জেলার রামুতে পর্যটক নিষিদ্ধ। সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটিত এ ধরনের খবরে প্রধান কারণ দেখানো হয় এই বলে যে, নিরাপত্তাজনিত কারণে সাময়িকভাবে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এরকম খবর প্রায়শ ছাপা হয়। কে কী ভাবেন জানি না। কিন্তু বছরখানিক আগে আমি বান্দরবানের গহীনে অবস্থিত প্রকৃতির এক আশ্চর্য নিদর্শন বগা লেক দেখতে গিয়েছিলাম। এর আগে কখনো বগা লেক দেখতে যাইনি। ফলে সেটি ছিলো চরম উত্তেজনাময়। রুমা বাজার থেকে বগা লেকের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। কিন্তু এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম ও বিপদজনক। ১০-১৫ গজ পরপরই পাহাড়ের বাক। কখনো খাড়া উঠে গেছে আধা-কিলোমিটার কখনো সাই করে নেমে গেছে অতটাই দূরত্ব। অভিযাত্রী তরুণদের জন্য সে যাত্রা সত্যিই আকর্ষণীয়। রুমা থেকে চান্দের গাড়িতে করে আমরা চারজন বগা লেকের দিকে রওনা হলাম। নিজেরা গল্প গুজবে ও প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে কথাবার্তায় এতোটাই মশগুল ছিলাম যে, বগা লেক যাত্রার বিপদের কথা একদম মনে আসেনি। বান্দরবান থেকে রুমা বাজার পেরিয়ে বগা লেকের দিকে যাত্রা। কিন্তু একটি ছোট সেতুর কাছে আমাদের থামতে হলো। এখান থেকে একজন গাইটকে সঙ্গি করা বাধ্যতামূলক। তাকে ৮০০ টাকা দিতে হবে। তার খাওয়াদাওয়া, চা-নাস্তাও দিতে হবে। সেটা বড় কথা নয়। মনে হলো বাধ্যতামূলক কেন? যে গাড়িতে যাবো সেই তো সব জানে। তাহলে আবার গাইট কেন। তা নিয়ে কারো সঙ্গে তর্কবির্তক করিনি।

আমাদের আগেই জানানো হয়েছিলো যে, রুমা থেকে বগা লেক যেতে রুমা বাজারের ক্যাম্পে আমাদের পরিচিতি, জাতীয় পরিচয়পত্র, গায়ে চিহ্নিত করার মতো কোন দাগ থাকলে সেগুলো উল্লেখ করতে হবে। সে রকম একটা ফর্ম দিলো বগা লেকের ক্যাম্প। ক্যাম্প মানে কয়েকটা লোক বসে আছে। পুলিশ টুলিশ নেই। এসব নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাইনি। তবে আমাদের গাড়ি ছাড়ার আগে গাইট কোথায় যেনো ফোন করে আমাদের বিবরণ জানালেন। এজন্য আধাঘন্টাও বেশি সময় লাগলো। ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটা গভীর খালের মতো। পানি আছে। মাছ চাষ হয় কিনা বলতে পারি না। তবে কেউ চাইলে মাছ চাষ করা সম্ভব।

আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা হলাম। পথে গাইটকে জিজ্ঞাস করলাম আমাদের এতো সব বিবরণ কেন নেয়া হলো। তিনি জানালেন, যদি গাড়ি এক্সিডেন্ট করে তাহলে বুঝতে পারছেন রাস্তা থেকে দুই তিন শ ফুট নিচে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে মৃত্যু অবধারিত। তখন যাতে আপনাদের লাশগুলো নিকটজনের কাছে পৌঁছানো যায়। বা তাদের খবর দেয়া যায় সেজন্যই এতো আয়োজন। গাইট লোকটা নির্বিকার মনে হলো আমরা সবাই মরে গেলেও সে বেঁচে থাকবে। যাই হোক অন্তত আশি থেকে একশত কিলোমিটার বেগে ঐ দুর্গম ও বিপদজনক ভয়ঙ্কর পাহাড়ি পথে চান্দের গাড়ি ছুটলো। সেটি চালাচ্ছিল ১৫-১৬ বছরের উপজাতীয় এক কিশোর। তাকে জিজ্ঞাস করলাম তুমি পারবে তো। সে ঝটপট জবাব দিলো প্রতিদিন অন্তত দুইটা ট্রিপ মারি। এই পর্যন্ত কোন বিপদ হয়নি। বাকিটা উপরওয়ালা জানে। আমরাও উপরওয়ালার কাছে জীবন সোপে দিয়ে শক্ত করে র‌্যালিং ধরে বসে থাকলাম। ঘন্টা খানিকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বগা লেক। আমাদের মতো বয়স্ক লোকদের দেখে তরুণ অভিযাত্রীরা এগিয়ে এলো। জানতে চাইলো, আমরা না হয় এসেছি আপনারা এলেন কোন সাহসে। বললাম তোমরা যে সাহস নিয়ে এসেছো, আমরাও একই সাহস নিয়ে এসেছি। আগে পর্যটকরা পায়ে হেঁটে ঝিরি ধরে সারাদিন হেঁটে বগা লেকে পৌঁছাতো। সেখানে উপজাতীয়দের বাড়ি ঘরেই ছিলো থাকার ব্যবস্থা। শহর থেকে নিয়ে যেতে হতো চালডাল মুরগিসহ রান্নার সব উপকরণ। কিছু টাকা দিলে উপজাতীয়রাই রান্নাবান্না থাকা খাওয়ার আয়োজন করে দিতো। এখন থাকার জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু লোকজন থাকে কম। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে। পথে পথে মিলিটারি ক্যাম্প, তারা গাড়ির লোকদের পর্যবেক্ষণ করে। কী দেখে, কে জানে। এই পথে উপজাতীয়দের পাড়া কম। সাধারণত পাঁচ সাত দশ ঘর লোক নিয়ে এক একটি পাড়া গঠিত হয়। কেন জানি না এই পথে একটি বা দুটি পাড়া চোখে পড়লো। আর সব উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। সবুজ শ্যামল। পাড়া না দেখে একটু খটকা লাগলো বৈকি।

তখনই মনে হয়েছিলো এখানে কি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আছে। সন্ত্রাসীদের কাছে উপজাতীয় বা সমতলে পার্থক্য নাই। বান্দরবানের অন্যান জায়গায় দশটি দোকানের একটি অন্তত বাঙ্গালীদের। বগা লেকের ধারে দোকান আছে বেশ কয়েকটি। থাকার জায়গা আছে । এখানে পানিরও ব্যবস্থা আছে। তাহলে বসতি কেন নেই। সেখানে কোন বাঙ্গালী থাকলে হয়তো জিজ্ঞাস করা যেতো। কেন নেই? উপজাতীয়দের কাছে এ বিষয়ে কথা বলাই সাহস পেলাম না। এরা দিনভর কাজ করে পাহাড়ে ফল বা জ¦ালানির সন্ধান করে। মাটির নিচের আলু বা ওল ঝাঁকা ভরে নিয়ে আসে। কিছু ফল বাজারেই বিক্রি করে দেয় কিছু খাবার জন্য নিয়ে যায়। এদের জীবনের চাহিদা কম। বিদ্যুৎ নেই, দোকান পাটে শ্যাম্পু ক্রিম নেই, যা কিছু প্রয়োজন তারা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে। যে খুব সৌখিন সে হয়তো সামান্য কেরোশিন তেল কিনে। দিনের আলো ফুরাবার আগেই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরে। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে তাদের নিজতরঙ্গ জীবন। রাতে হাঠাৎ কোথাও সামান্য হল্লা শোনা যায়। কখনো কখনো জ¦লে উঠে বোন-ফায়ার। শুকর পুড়িয়ে চোলাই মদ খেয়ে তারা উৎসব করে। কিন্তু একাজেরও তারা বাধার সম্মুখিন হয়। সেটা তাদের মোটেও পছন্দ নয়। বগা লেকের ভ্রমণ শেষে থাকলাম চিম্বক পাহাড়ে। সেখান থেকে বান্দরবান। রাতে হোটেল পরদিন ঢাকার দিকে যাত্রা।

সেরকম সুন্দর একটি পরিবেশে হুট করেই কেন রুমায় পর্যটক নিষিদ্ধ করা হলো। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঢাকায় ফিরে পুরোনো বৃত্তে জীবন চলতে থাকলো। তারপর আরো একটি ছোট্ট খবর বের হলো পত্রিকায়। শুধু রুমা নয় থানচিতেও পর্যটকদের যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। থানচি পাহাড়ি নদী ও ঝড়নার অপূর্ব এক সমাহার। বান্দরবান বাসিরা বলেন, এখানে এসে থানচিতে না গেলে ভ্রমণই সম্পূর্ণ হয় না।

আমার খটকা লাগতে থাকলো অন্যত্র। বান্দররানে কেন একের পর এক পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। পাহাড় সম্পর্কে কেউ তো মুখ খুলে কথা বলতে চায় না। ১৭ জানুয়ারি পত্রিকার খবরে জানা গেলো, সেখানে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদি গ্রুপ রিতিমত যুদ্ধ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের দ’ু হাজার সদস্য ইউনিফ্রম পরে অস্ত্র হাতে পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এরকম একটি ভিডিও তার বেশ আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো। তখন মনে হয়েছিলো এতোগুলো মানুষ এতো অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে পাহাড়ের গহীনে অনেক দিন ধরে প্রশিক্ষণ নিয়েচ্ছে। অথচ আমাদের প্রশাসন সেটি কেন জানতে পারলো না। কেন তাদের ধরার বা উচ্ছেদের কোন খবর পেলাম না।

পত্রিকায় খবরটি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাতে কুকিচিনের বিচ্ছিন্নতাবাদি আনন্দোলন যতনা পাধান্য পেয়েছে তারচেয়ে বেশি পাধান্য পেয়েছে নব গঠিত তথাকথিত জঙ্গী সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল সারকীয়ার’ নাম। বলা হয় সেখানে আমিনুল নামক এক যুবক কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কাছে অর্থের বিনিমনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলো। আমিনুলরা সংখায় কতোজন ছিলো তা জানা যায়নি । র‌্যাব বলেছে, সম্প্রতি ঘর ছাড়া কয়েকজন তরুণকে গ্রেফতারের পর এই ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। আটক তরুণরা জানিয়েছে, ২৫ নভেম্বর আমিনুল মারা যায়। কী করে মারা যায় তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় নি। কোন কোন সূত্র বলেছে, গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে আামিনুল খুদা তৃৃষ্ণায় মারা গেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, নিজেদের অন্তরদ্বন্দ্বে আমিনুলের মৃত্যু হয়। আমিনুলের ‘সঙ্গীদের’ মতে কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যরা মিলে আমিনুলকে পাহাড়ে পুতে রাখে। তার লাশ কম্বলে পেঁচিয়ে জঙ্গলে পোতা হয়। আমিনুলের পরিবার ও র‌্যাব জানায়, আমিনুলের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে রোববার গহীন পাহাড়ে ঐ কবর খোঁড়া হয়। এসময় কবর খুঁজতে তাদের সহায়তা করে জামাতুল আনসারের দুই সদস্য। তবে কবর খুঁজে পাওয়া গেলেও সেখানে লাশ পাওয়া যায়নি। শুধু মিলেছে একটি কম্বল। আমিনুল ছারাও পাহাড়ে কেএনএফ আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে জোহায়ের বিন রহমান নামে আরেকজন নিহত হন। জঙ্গীরা তার নতুন নাম দিয়েছিলো ডা. আহমেদ। তিনি ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। সে কারণে তাকে ডাক্টার হিসেবে সম্বোধন করা হতো। তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কুকিচিনের আস্তানায় থাকাকালে জোহায়ের অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় নিহত হন বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছে। এখানে কেএনএফ’র কোন সদস্য হাতাহত হয়েছে বলে জানা যায়নি। আমিনুলরা সংখ্যায় কতোজন ছিলো তাও জানা যায়নি। জোহায়েরের স্ত্রী হাজেরা আক্তার বলেছেন, ২০২১ সালের ৩০শে আগস্ট বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি তার স্বামী। ঘর ছাড়ার আগে বলেছিলেন, তিনি তুরস্কে যাবেন। নিখোঁজ হওয়ার পর গত ২২ মে সর্বশেষ কথা হয়েছিলো। পরে র‌্যাবের মাধ্যমে জানতে পারি জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে তিনি পাহাড়ে নিহত হয়েছেন। লাশটা পেলেও তো সন্তানদের শান্তনা দিতে পারতাম। কিন্তু কেন কবরটি খুঁড়ে সেখানে কোন লাশ পাওয়া গেলো না। ধরণা করা হয় পুতে রাখা যায়গা থেকে কেউ তার লাশ সরিয়ে ফেলেছে।

আমিনুলরা সংখ্যায় কতোজন ছিলো সেটি সম্ভবত বড় কথা নয়, বড় কথা হলো কেএনএফ কেমন করে এতো বড় একটা বিচ্ছিন্নতাবাদি জঙ্গী সংগঠন গড়ে তুলতে পারলো। তাদের প্রতিরোধে সরকার একের পর এক পর্যটন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাদের প্রতিরোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। কুকিচিন বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতা নাথাম বম ঢাকার বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মাস্টার্স করেছেন। তারপর গড়ে তুলেছেন কেএনএফ। নাথাম বমকে গ্রেফতার করার জন্য মাঠে নামে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বান্দরবান, খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত এলাকা ও পাহাড়ের পাদদেশে অভিযান চালালেও তাকে গ্রেফতার করা যায় নি। বান্দরবানের যে এলাকায় ক্যাম্প খুলে ঘাঁটি গেড়েছিলো বম সেখান থেকে সে ও তার বাহিনীর লোকজন পালিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলেছে, তাদের অভিযানের কারণে বম পিছু হটেছে। তবে তার এই পিছু হটাকে দুর্বলতা ভাবছে না তারা। সে যাতে আবার সংগঠিত হতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। র‌্যাব সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, নাথান বম মিয়ানমারে পালিয়ে গেছে। তবে পুলিশ বলেছে, নাথান বমের অবস্থান তাদের জানা নেই।

আসলে পুরো ঘটনাটি একটি বিচ্ছিতাবাদি গ্রুপের উত্থানের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এর সঙ্গে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল সারকীয়ার’ জঙ্গী সংগঠনের সম্পৃক্ততা কোনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ যে দুজন নিহত হয়েছেন তাদের কারো লাশ পাওয়া যায় নি। তাহলে ঐ জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত এলো কোথা থেকে। এখন সবচেয়ে প্রয়োজন পার্বত্য চট্টগ্রামের এই নতুন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদিদের দমন করা। এর মধ্যে জঙ্গীর খোঁজ বা সম্পৃক্ততা খড়ের গাঁদায় সুঁচ খোঁজার সামিল।

https://dailysangram.com/post/514838