২৫ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ৬:২৮

ওষুধের বাজার অস্থির

এইচ এম আকতার: ওষুধের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ওষুধ উৎপাদন খরচ অন্তত ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে উৎপাদনকারীরা মনে করছেন। এতে করে সার্বিকভাবে চিকিৎসা খরচও বাড়বে। গত ৫ মাসেই বেড়েছে কয়েক দফা। তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ জুলাই ৫৩টি ওষুধের দাম পুনর্র্নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু এরপরেও ওষুধের দাম বাড়ছেই। অবস্থা দেখে মনে হয় এসব দেখার কেউ নেই।তবে ব্যবসায়ীরা বলছে,ডলার সংকটের কারণে ওষুধের দাম বাড়ছে।

গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিট মূল্য ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছে। এতে করে ওষুধের দাম আরও ২৫ শতাংশ বাড়তে পারে। এতে করে মধ্য এবং নিম্ম মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কষ্ট হচ্ছে। অনেকে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বাপি) মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, সরকার ও উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা স্থানীয় ওষুধ শিল্পকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যা দেশে ও বিদেশে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। তবে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলার সংকট এই খাতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

মার্কিন ডলারের ঘাটতির কারণে উৎপাদন খরচ প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সেই অনুযায়ী ওষুধের দাম সমন্বয় করবে।

তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে ওষুধ প্রস্তুতকারকদের উৎপাদন খরচ বেশি হবে। কিন্তু বাড়তি উৎপাদন খরচের পুরোটা ভোক্তাদের কাছ থেকে নেয়াও যাচ্ছে না।

শফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ৫০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মুন্সীগঞ্জের অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কারখানা স্থাপন করছে, কিন্তু গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদনে যেতে পারছে না। ফলে লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

দাম বৃদ্ধির এই তালিকায় ছিল প্যারাসিটামল, মেট্রোনিডাজল, এমোক্সিলিন, ডায়াজিপাম, ফেনোবারবিটাল, এসপিরিন, ফেনোক্সিমিথাইল, পেনিসিলিনসহ অন্যান্য জেনেরিকের ওষুধ। ২০১৩ সালের পর ওই ওষুধগুলোর দাম বাড়ানো হয়। গত ছয় মাসে এসব ওষুধের দাম ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, এন্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারীরা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ৪৬৫ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৫৯৯ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন ডলার।

একইভাবে, ওষুধ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এলসির পরিমাণ ৩৫ দশমিক ১৫ শতাংশ কমে ৬৫ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ওষুধ উৎপাদকরা ঠিক সময়ের মধ্যে ওষুধ রপ্তানি করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা, এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের ওষুধ খাতের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতে পারে। বর্তমানে অবস্থা আরো খারাপ। ব্যবসায়ীরা এলসি খোলতে ব্যাংক থেকে ব্যাংকে ঘুরছে।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওষুধ শিল্প একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় ব্যাংকগুলো এলসি খুলতেও দেরি করছে।'

বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদন খাতের জন্য বছরে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কারণ স্থানীয়ভাবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি কাঁচামাল সংগ্রহ করা যায় না। দেশের ওষুধ শিল্প স্থানীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে।

ডলার বাঁচাতে অপ্রয়োজনীয় আমদানি সীমিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানির বিষয়ে কঠোর হওয়ায় গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরে মধ্যে বাংলাদেশে সামগ্রিক এলসি খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ কমেছে।

এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এম মহিবুজ জামান বলেন, উদ্যোক্তারা এলসি খোলার জন্য পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছেন না। এলসি খোলার অনুমোদন দিতে ব্যাংকগুলো বেশি সময় নিচ্ছে, এতে লিড টাইম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।'

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক ড.মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিচ্ছে। স্বাস্থ্য ও সুস্থতা খাদ্য ও জ্বালানির মতোই অপরিহার্য। তাই, ওষুধের সরবরাহ, প্রাপ্যতা ও দাম যাতে প্রভাবিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
এই দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে তখন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন বলেছিলেন, কাঁচামালের দাম ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কোম্পানিগুলো লোকসান দিয়ে তো ব্যবসা করবে না। তবে ওষধ প্রশাসন এককভাবে কারো দাম বাড়িয়ে দেয় না। যখন যে কোম্পানি দাম বাড়াতে আসবে, তারা যদি ব্যয়ের কারণ দেখাতে পারে- তখন সেটি আমাদের ফর্মুলার মধ্যে যদি থাকে তাহলে দামটা বাড়াতে পারে। তবে অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কেউ দাম বাড়াতে পারে না।

জানা যায়, লিবরা ইনফিউশনের ২৩টির মতো স্যালাইন পণ্য রয়েছে বাজারে। এগুলো প্রতি প্যাকেট ৩৫ থেকে ১৪৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। গত মাসে এসএমসির ওরস্যালাইনের দাম প্রতি পিসে ১ থেকে ২ টাকা টাকা বাড়ানো হয়েছে।

এসব ওষুধের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বাড়াসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে স্যালাইনসহ বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছিল কোম্পানিগুলো। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এর আগে গত জুন মাসে ওষুধের দাম নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি ওষুধের দাম ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।

https://dailysangram.com/post/514701