২৪ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:০২

ত্রাণের কম্বল কিনতে পারছে না সরকার

ত্রাণের কম্বল কেনার জন্য গত তিন অর্থবছরে ১৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কোনো কম্বল কিনতে পারেনি। পরে ওই অর্থ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ও ডিসি-ইউএনওদের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় মান ঠিক রেখে কম্বল কেনা সম্ভব হয়নি।

ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শীতার্তদের জন্য কম্বল কিনতে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের দুই মাসেরও বেশি সময় পর দরপত্র আহ্বান করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। উত্তরাঞ্চল, খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকা—এই চার ভাগে কম্বল কেনার প্রক্রিয়া শুরু করতেই তীব্র শীত এসে যায়। কম্বল কেনার জন্য দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু কম্বলের স্পেসিফিকেশন (মানসংক্রান্ত শর্ত) পূরণ না হওয়ায় সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র বাতিল করা হয়। এর মধ্যে মাঘের শীত এসেছে। তৃতীয় দফায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী শর্ত শিথিল করবেন—এই আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদাররা। নতুন শর্তে ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে দুটি প্রতিষ্ঠান কম্বল দেওয়ার চুক্তি করেছে।

তবে চুক্তি অনুযায়ী কম্বল সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ তাদের সরবরাহ করা অনেক কম্বল নিম্নমানের। ফলে প্রতিষ্ঠান দুটির কম্বল বুঝে নিতে পারছে না অধিদপ্তর। চট্টগ্রাম ও উত্তরাঞ্চলে এখনো কম্বল কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ত্রাণের কম্বল বাজারে পাওয়া যায় না। ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে সাউথ বেঙ্গল ও এশিয়ান টেক্সটাইল নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এখনো চুক্তি হয়নি। আর চট্টগ্রামে শেষবারের টেন্ডারও বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ করা যেসব কম্বল নিম্নমানের সেগুলো বাদ দিয়ে দ্রুত নেওয়ার চেষ্টা করছি। চুক্তি অনুযায়ী সব কম্বল সরবরাহ করতে না পারলে যে পর্যন্ত বিল বাকি থাকবে সে পর্যন্ত জামানত বাতিল করা হতে পারে।’

মান কমিয়েও কিনতে পারছে না কম্বল : আগের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কম্বল না পাওয়ায় ২০২১ সালে কম্বলের মান শীথিল করা হয়। এর পরও কম্বল কেনা যায়নি। আগের মান অনুযায়ী প্রতিটি কম্বলের ওজন হতো আড়াই কেজি। ২০২১ সালে তা কমিয়ে দেড় কেজি নির্ধারণ করা হয়। লেয়ার দুই পার্ট থেকে এক পার্ট করা হয়েছে। দৈর্ঘ্য আট ফিট থেকে করা হয়েছে সাত ফিট।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেওয়ান মোর্শেদ আহমেদ বলেন, ‘দুই বছর আগে করা স্পেসিফিকেশন দিয়ে অবশ্যই কম্বল কেনা সম্ভব। কারণ কম্বলের এই স্পেসিফিকেশন একটি বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে করা হয়েছে।’

ঠিকাদাররা কম্বল সরবরাহের জন্য মান আরো কমানোর দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজার বিবেচনা করে কম্বলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কারো না পোষাইলে টেন্ডারে অংশ নেবে না। অংশ নিলে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী দিতে হবে। স্পেসিফিকেশন সংশোধনের কোনো চিন্তা নেই। এই স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী আগামী বছরও টেন্ডার হবে। মাঠে যে টাকা দেওয়া হয়েছে তারাও স্পেসিফিকেশন অনুসরণ করবে।

কম্বল কিনতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের তো একটা স্পেসিফিকেশন আছে। সে অনুযায়ী কম্বল না পাওয়ায় কেনা হয়নি। এ বছর বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে কম্বল কেনার কাজ শুরু হয়েছে।

মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী, ত্রাণের কম্বল কেনার কাজ বাস্তবায়ন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এ কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটিও রয়েছে। ১৫ সদস্যের এ কমিটির সভাপতি হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব।

তীব্র শীত পড়া উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা অন্তত চার হাজার। অথচ এ ইউনিয়নে ৩২৭টি কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ আবেদ আলী সম্প্রতি বলেন, শীতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখনো কোনো কম্বল পেলাম না। তিরনইহাটের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসাইন বলেন, ‘ত্রাণের কম্বল সামান্য মানুষের চাপে দিনে বিতরণ করতে পারছি না।’ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ১০টি ইউপি চেয়ারম্যান বরাদ্দের কম্বল কম হওয়ায় ফেরত দিয়েছেন।

জরুরি বরাদ্দের ৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকারও কম্বল কিনতে পারেনি : জরুরি ভিত্তিতে কম্বল কেনার জন্য গত ৯ জানুয়ারি ৪৯৪ জন ইউএনওর অনুকূলে ৯ কোটি ৮৮ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দের ১১ দিন পরও বেশির ভাগ উপজেলায় কেনা হয়নি কম্বল। কয়েকটি উপজেলায় কেনা হলেও সেই কম্বল গরিব মানুষের হাতে পৌঁছেনি।

গত ২৯ ডিসেম্বর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নির্বাচনী এলাকায় বিতরণের জন্য ডিসিদের নামে এক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। বাকি ৪৪ কোটি টাকায় দেশের চার অঞ্চলে কম্বল কেনার জন্য দুই দফায় টেন্ডার আহ্বানের পরও কম্বল কিনতে পারেনি।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণের কম্বল কেনার জন্য দেশের সব উপজেলায় অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলায় এখনো কেউ বরাদ্দপত্র পায়নি। ঢাকা, নীলফামারী, বগুড়া, পঞ্চগড় ও চট্টগ্রাম জেলার ১৫ জন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা বলেন, জরুরি বরাদ্দের অর্থের টাকায় তারা কম্বল কিনতে পারেনি।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান তাঁর নিজ এলাকা সাভারের প্রত্যেক ইউপির জন্য মাত্র ২০০টি করে কম্বল বরাদ্দ পেয়েছেন। গত ১৩, ১৪ ও ১৯ জানুয়ারি তিনি উপস্থিত থেকে কম্বল বিতরণ করেন। পরে কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান নিজের টাকায় কম্বল দিয়েছেন।

খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাট ও সিলেট জেলার ১০ জন ইউএনও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাণ্ডার থেকে কিছু কম্বল এসেছিল, সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ অধিদপ্তরের কোনো কম্বল পাইনি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/01/24/1235294