২৪ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:৫৮

১ বছরে সড়কে নিহত ১২৩৭

বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বের হয়ে গত রোববার দুপুরে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় ঘটনাস্থলেই মারা যান শিক্ষার্থী নাদিয়া। দুই সপ্তাহ আগে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন নাদিয়া। ১৯ বছর বয়সী নাদিয়া সুলতানার স্বপ্ন ছিল ফার্মাসিস্ট হবেন। ক্লাস করতে এক সপ্তাহ আগে নারায়ণগঞ্জের বাসা ছেড়ে উত্তরার একটি মেসে ওঠেন। এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার সেই স্বপ্নযাত্রার ইতি ঘটলো। নাদিয়া নিহতের ঘটনায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের চালক মো. লিটন ও হেলপার মো. আবুল খায়ের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গত বছরের ৫ই নভেম্বর বন্ধুর সঙ্গে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বেড়াতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নিমতলা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মো. সাবাব আজাদ নামের ওই তরুণের বাসা ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায়। তার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ। দুর্ঘটনার সময় তার সঙ্গে ছিল মো. সিয়াম নামের এক বন্ধু।

পরিবারের সদস্যরা জানায়, দুই বন্ধু মাওয়ায় বেড়াতে যায়। ঢাকায় ফেরার পথে নিমতলা এলাকায় তাদের প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুজনই গুরুতর আহত হয়। রাত ১টার দিকে সাবাব ও সিয়ামকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সবাবকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ২০২১ সালের ২৪শে নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। এ ঘটনায় মামলা শেষে চালককে গ্রেপ্তার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিচারিক কার্যক্রম এখনো চলমান। তার বাবা মো. শাহ আলম দেওয়ান বলেন, নাঈমের মা জান্নাতুল ফেরদৌস সারাক্ষণই ছেলের কথা বলতে বলতে কাঁদেন। ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে গেছেন বাবা-মা দুজনই। তিনি বলেন, সরকারের এত প্রতিশ্রুতির পরও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমেনি। এর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে সারা দেশব্যপী আন্দোলন করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি এবং আশ্বাস পেয়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরলেও সড়ক নিরাপদ হয়নি। সড়কে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর মিছিল সুদীর্ঘ হচ্ছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। গড়ে প্রতিদিন অন্তত ৩ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। বিদায়ী বছর ২০২২ সালের মে, জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর-এই ৪ মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন এবং অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী। যাদের বড় অংশের মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ মানবজমিনকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সরব থাকি যতক্ষণ আলোচিত বা বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং সাধারণ মানুষের করণীয়সহ একাধিক প্রস্তাব দেয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, বিশেষ করে রাজধানীর ফুটপাথগুলো চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় মানুষজন রাস্তায় নেমে পড়েন। এতে গাড়ির সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ এবং পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবেও সংকটে পড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতিগ্রস্ত মানবসম্পদের আর্থিক মূল্য ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই ক্ষতি কীভাবে পোসাবে সরকার।

https://mzamin.com/news.php?news=39754