২২ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৩:৩৯

জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ


লাগামহীনভাবে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়তে থাকায় দেশে প্রতিবছর জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। আগের বছরের জীবনযাত্রার ব্যয় ছাড়িয়ে যাচ্ছে পরের বছরে। ব্যয় বাড়লেও খুব একটা বাড়েনি আয়। শনিবার ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক মাহফুজ কবীর। রাজধানী ঢাকায় ১১টি খুচরা বাজার এবং বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১৪১টি খাদ্যপণ্য, ৪৯টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও ২৫টি পরিষেবা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১০.৮ শতাংশ। যেখানে ২০২১ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার ছিল ৬.৯২ শতাংশ। এ হিসাবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার ৩.১৬ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকায় বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালের প্রথম মাসের তুলনায় ১০.০৮ শতাংশ বেশি ছিল। যদিও গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি আর খাদ্যবহির্ভূত অংশের তুলনায় কম ছিল যথাক্রমে ১০.০৩ ও ১২.৩২ শতাংশ, উভয়ই দুই অঙ্ক স্পর্শ করেছে। তবে সাধারণ পরিবারের তুলনায় নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর গড় মূল্যস্ফীতির চাপ ৯.১৩ শতাংশ কম ছিল।

বার্ষিক খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি যথাক্রমে ১০.৪১ ও ৭.৭৬ শতাংশ কম ছিল, যদিও উভয় শ্রেণির পণ্য ও সেবা মৌলিক প্রকৃতির ছিল।
ক্যাব জানায়, ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল, যখন এটি জানুয়ারির তুলনায় ৭.২৯ শতাংশে পৌঁছেছিল। জুলাই মাস পর্যন্ত খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির তুলনায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কম ছিল, যখন তা ৯.৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। জুনে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছায় (১১.২৫ শতাংশ), যা সেই মাসে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বাড়াতে সাহায্য করেছিল (১০.৪ শতাংশ)। জুলাই মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ (১৮.৬ শতাংশ), যা প্রধানত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে হয়েছিল। এটি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫.৮৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ (১৭.২৫ শতাংশ) হয়েছিল। এটি পরের মাসগুলোতে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। যদিও এটি ডিসেম্বরে দুই অঙ্কের মধ্যে ছিল (১২.১ শতাংশ)। অন্যদিকে, আগস্টে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছিল (১৪.৭ শতাংশ) কিন্তু পরে তা আবারো ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়তে থাকে (১৬.০৩ শতাংশ)।

মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বিশ্লেষণের আলোকে নীতিগত সুপারিশের প্রস্তাব করেছে ক্যাব। সুপারিশে ক্যাব জানায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নি¤œআয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস স্কিমকে শক্তিশালী করা উচিত। বাংলাদেশে এক কোটি পরিবারের খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। এ ছাড়াও, অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ হস্তান্তর কর্মসূচি বৃদ্ধি করা উচিত। যেহেতু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ এবং অসহায়ত্বের সম্মুখীন হয়, তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নি¤œআয়ের মানুষের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত।

সুপারিশে বলা হয়েছে, শহুরে নি¤œ-মধ্যম এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। মৌলিক জ্বালানি পণ্য, বিশেষ করে ডিজেলের ওপর আবার ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে। কারণ এটি সেচ এবং জনসাধারণ এবং পণ্য পরিবহন খরচের একটি বড় অংশ নির্ধারণ করে। অন্যান্য আমদানি করা জ্বালানি পণ্যের জন্য স্বয়ংক্রিয় মূল্যপ্রবাহ এবং সমন্বয় ব্যবস্থাপনা করা উচিত। তবে অদূর ভবিষ্যতে খুচরা বা গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত হবে না। কেননা, শিল্প পর্যায়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব এখনই পড়তে শুরু করেছে।

প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে বিআইআইএসএসের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, কয়েকটি পণ্য ও সেবায় দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এই পণ্য ও সেবাগুলো হলো-চাল, আটা, ডাল, বেকারি পণ্য, চিনি, মাছ, ডিম, দেশি মুরগি, ভোজ্য তেল, আমদানিকৃত ফল, চা ও কফি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও আমদানি করা দুধ, পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী ও পরিবহন খরচ।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের তুলনায় উচ্চবিত্তের আয় অনেক বেশি হয়েছে। এখনো দেশে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দিন দিন এ আয় বৈষম্য বাড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য কাল হয়ে এসেছে। আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে সাধারণ মানুষের আয় বাড়াতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান গোলাম রহমান। তিনি বলেন, দেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা দ্রুত কমবে, এটা আশা করা যায় না। এজন্য সাধারণ মানুষের আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। তা না হলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। ২০২২ সালটা সাধারণ মানুষের জন্য একদমই স্বস্তির ছিল না জানিয়ে গোলাম রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারও অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে যতটা খারাপ পরিস্থিতি হতে পারতো, সেটা হয়নি।

https://mzamin.com/news.php?news=39493