২২ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৩:২৪

খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা

ছাড় দিয়েও মিলছে না সুফল

সরদার আবদুর রহমান: দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোতে শ্রেণিকৃত তথা খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। ঋণ পরিশোধে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোর বড়ো গ্রাহকদের গা-ছাড়া ভাবের কারণে এই খেলাপির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েও তেমন সুফল মিলছে না বলে জানা গেছে।

বেড়েই চলেছে ঋণখেলাপি
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত বছর আগস্ট মাসে খেলাপি ঋণের সর্বশেষ যে পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায় তাতে এর পরিমাণ সোয়া এক লাখ কোটি টাকা ছড়িয়ে যায়। এর আগে গতবছর ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। খেলাপিতে পরিণত হয়েছে মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর জুলাই মাসে ঋণ খেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেয়। ঋণের শতকরা আড়াই থেকে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এর আগে এটা ছিল শতকরা ১০ শতাংশ।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর ঋণ পরিশোধে ছাড় দেয়া হয়। এ কারণে প্রায় দুবছর ঋণ পরিশোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। এরপর ঋণ পরিশোধে ছাড় কিছুটা উঠে গেলে পুরোনো খেলাপিদের পাশাপাশি অনেকে নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েন। এর কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়।

এদিকে, এ ছাড়ের কারণে গত বছরের প্রথম ছয় মাসে শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপির কাছ থেকে মোট ১১৯.৩৮ কোটি টাকা আদায় করে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যা তাদের বার্ষিক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ৬ শতাংশেরও কম বলে তথ্যে জানা গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে এই ছয় ঋণদাতা- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বেসিক ব্যাংকের এসব খেলাপিদের কাছে মোট শ্রেণিকৃত ঋণ ছিল ২১ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ছয় ব্যাংকের মধ্যে বছরের প্রথমার্ধে আদায়ের হার সবচেয়ে খারাপ ছিল সোনালী ব্যাংকের। রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড়ো এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটি মোট ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে যৎসামান্য বা মাত্র ৩৮ লাখ টাকা আদায় করতে পেরেছে তাদের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছ থেকে। অথচ ব্যাংকটির বার্ষিক আদায় লক্ষ্যমাত্রা ৩০০ কোটি টাকা- যার তুলনায় প্রকৃত আদায় হয়েছে ০.১৩ শতাংশ মাত্র। অপরদিকে, জানুয়ারি-জুন মেয়াদে নিজেদের শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের থেকে সবচেয়ে বেশি আদায়ের হার ছিল অগ্রণী ব্যাংকের। বার্ষিক ৩০০ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে ৮৭ কোটি টাকা বা লক্ষ্যের ২৯ শতাংশ। সে তুলনায় অগ্রণীর শীর্ষ ২০ জন ঋণগ্রহীতার কাছে খেলাপি ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে সবচেয়ে বেশি বা ৮ হাজার ১০৯ কোটি টাকা পাওনা জনতা ব্যাংকের। বার্ষিক ৮০০ কোটি টাকা ঋণ আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি ঋণ আদায় করতে পেরেছে ১০ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ১.২৫ শতাংশ। বিডিবিএল বার্ষিক ১০ কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ বা ২ কোটি টাকা আদায় করেছে। গত অক্টোবরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বৈঠকের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সব কয়টি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে তাদের মোট শ্রেণিকৃত ঋণের সিংহভাগ রয়েছে। এদের কাছ থেকে আদায় হলে ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণ অনেক কমে যাবে।

১০ বছরে বৃদ্ধি ৩ গুণেরও বেশি
দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত ১০ বছরে ৩ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘অর্থনৈতিক সংকট ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে আদালতের স্থগিতাদেশ আছে এমন ঋণ এবং পুনঃ তফসিলকৃত ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয় হলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো বেশি হবে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছে সিপিডি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক পরিচালকদের নিয়োগ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দেয়া, স্বার্থান্বেষীদের পক্ষে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের সংশোধনী, আর্থিক ঋণ আদালত আইনের দুর্বলতা, দেউলিয়া বিষয়ে আইনে ফাঁকফোকর, তথ্যের মান নিয়ে সমস্যা, সঠিক তথ্যের অনুপস্থিতি, ঋণ পাওয়ার জন্য মিথ্যা তথ্য, জাল নথি ও ভুয়া কোম্পানির পরিচয় প্রভৃতি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণখেলাপি হতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আলাদা। এখানে নিয়ম নীতি না মেনে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দেয়া হয়। আর সেই ঋণ যারা নেন তারা আর ফেরত দেন না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক দেখা গেলেও এর দায় কিন্তু অল্প কয়েকজনের। ব্যাংকিং খাত তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা এই খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। ফলে প্রকৃত যারা বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা তারা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। আর দেশের অর্থনীতি পড়ছে সংকটে।

https://dailysangram.com/post/514414