২১ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৫:১৬

ইতিহাস বিকৃতি ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ

নতুন পাঠ্যক্রমের নতুন বই নিয়ে বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। বইগুলোতে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলাম এবং মুসলমান প্রসঙ্গ। শুধু এড়িয়েই যাওয়া হয়নি, বরং, ইসলাম এবং মুসলিম ধর্মাচার বিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মুসলিম ঐতিহ্যকে হেয় করা হয়েছে সুকৌশলে। পাশাপাশি বইগুলোতে যৌন বিকৃতিকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে চালু হওয়া পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে, বিক্ষোভ করছে বিভিন্ন সংগঠন। তারা অবিলম্বে ইসলাম বিরোধী বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তক বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মুসলিম জনগোষ্ঠির নতুন প্রজন্মকে অন্তসারশূন্য সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

২০২৩ সাল থেকে সারাদেশে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে স্কুল ও মাদরাসায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে পাঠদান শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে পঠিতব্য দশটি বিষয় হল বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্মশিক্ষা।

পাঠ্যবইগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অধ্যায়ে ইসলামবিদ্বেষ ফুটে উঠেছে বইগুলোতে। সম্প্রীতি শেখানোর নামে, স্বাধীনতা শেখানোর নামে শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ইসলামবিদ্বেষ। পাশাপাশি সযত্মে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামি নিদর্শন, ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতির আলোচনা। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি ঐতিহ্য আড়ালের চেষ্টা হয়েছে। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটিই পড়ে দেখা গেছে, বইয়ের অধিকাংশ পৃষ্ঠাজুড়েই রয়েছে হরপ্পা সভ্যতা ও মাহেঞ্জোদারোর গল্প। এখানে দেখানো হয়েছে, তারা খুবই সভ্য আর শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল। তাদের ছিল অনেক সুন্দর সুন্দর পানি নিষ্কাষণ ড্রেইন। ছিল স্বাধীনতা, বিস্তৃত রাস্তাঘাট, সূক্ষ্ম পরিমাপ পদ্ধতি, শিল্পকলা ইত্যাদি। মূলত তারা ছিল উৎকৃষ্ট এক জনগোষ্ঠী। তাদের ধর্ম বেদের উপর নির্ভরশীল। বেদের প্রকারভেদ নিয়েও বেশ ভালো আলোচনা কয়েকবার এসেছে। এখানে বিস্তৃত আলাপ করা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও তার শাসনব্যবস্থা নিয়ে। তাদের মুদ্রা, মন্দির, স্থাপনা, ধর্মীয় গ্রন্থ, দেব-দেবীর ছবি, বৌদ্ধ বিহার আর মন্দিরের ছবিতে সয়লাব পুরো বই। একই উদাহরণ পাওয়া গেছে অন্য বইগুলোতেও। সেগুলোতেও বৌদ্ধ বিহার, হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমার বহু ছবি দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধস্তূপে ভক্ত ও উপাসনাকারীদের ছবিও রয়েছে। বাস্তব কিংবা কল্পিত ছবি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবিই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।

বইগুলোতে ইসলামি ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সযতেœ। যেমন ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটতে মসজিদের ছবি এসেছে মাত্র তিনটি। তাও বইয়ের একদম শেষদিকে। বাংলা বইসহ আরও কয়েকটি বই ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানেও একই দৃশ্য। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন জিনিস উল্লেখ করা হলেও ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষঙ্গের ছবি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সচেতনভাবে। ইতিহাসজুড়ে মুসলিম ঐতিহ্যের যে অবদান, তার কথা তুলেই ধরা হয়নি।

ষষ্ঠ শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে বিতর্কিত বিবর্তন মতবাদ। এতে দেখানো হয়েছে কীভাবে বানর বা এই জাতীয় অন্য প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ বর্ণনার পাশাপাশি ছবি দ্বারা এ বিবর্তনকে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ‘লুসি’নামক কথিত কঙ্কালকে মানুষের পূর্বসূরী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুসির ছবিও দেওয়া হয়েছে বইটিতে। তাছাড়া বইটির অনুসন্ধানী পাঠে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমন সব মনগড়া বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, যা কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলামানদের আকীদা বিশ্বাসের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের বইগুলোতে মুসলিম ইতিহাসকে শুধু এড়িয়েই যাওয়া হয়নি, বরং মুসলিম ইতিহাসের প্রতি করা হয়েছে এক ধরনের বিষোদগার। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাসের বইগুলোতে বাংলায় প্রায় ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনকে আগেকার মৌর্য ও গুপ্ত সা¤্রাজ্য এবং পরের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সবগুলোই ‘বিদেশীদের শাসন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সবাই নিজেদের ভাষা-ধর্ম-রাজনীতি এখানকার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যেমন মুসলিম বিজেতা বখতিয়ার খিলজীকে বলা হয়েছে দখলদার। বলা হয়েছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন। কয়েকটি বিহার ধ্বংস করেছিলেন।

পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর বইগুলোর বিভিন্ন অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কথা আনা হয়েছে। কিন্তু এসব আলোচনাতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ইসলামী আন্দোলনগুলোকে। শহীদ তিতুমীর এবং ফরায়েজী আন্দোলনের কথা একেবারেই অনুপস্থিত। কোথাও কোন উল্লেখ নেই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে আলেমগণের ভূমিকা এবং আত্মত্যাগের। অন্যদিকে বিভিন্ন শ্রেণীর বইতে বারবার কলকাতাকেন্দ্রিক বেঙ্গল রেনেসাঁ (নবজাগরণ), স্বদেশী আন্দোলন এবং ক্ষুদিরাম-সূর্যসেনদের সশস্ত্র আন্দোলনের কথা এসেছে।

বাংলা বইয়ে কাল্পনিক ও অবাস্তব ছড়া, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঝগড়া শেখানোর মতো কল্পনানির্ভর শিক্ষাহীন গল্পের পাশাপাশি কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে গান শোনা, গান শেখা, বাদ্যযন্ত্র যেমন, হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা, ঢোল ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।

ইংরেজি বইয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিভিন্ন পৃষ্ঠায় মানুষের সাথে কুকুরের ছবি এবং নেকড়ে বাঘের ছবি দেওয়া হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই অংশবিশেষ। তাছাড়া একটি গল্পে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান এ চার ধর্মের চারজন বন্ধুর পরস্পর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খুবই আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ এবং হিন্দুদের দুর্গা পূজায় অংশগ্রহণ করে সকলে একত্রে নাচের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপনের বর্ণনা রয়েছে। এতে হিন্দুদের পুজায় অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। যা মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও বিশ্বাস থেকে আপত্তিকর।

ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই এর আত্মপরিচয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে, আমাদের আত্ম পরিচয় গঠনে ইসলামের কোন ভূমিকা নেই, এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটিতে, দেশে মুসলিম শাসনকে উপেক্ষা করে হিন্দু শাসকদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আন্দোলন সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বইটির অনুসন্ধানী পাঠে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনায় এমন সব মনগড়া বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, যা কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলামানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থি।
প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস বর্ণনায় প্রাচীন মানুষ ও দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবির পাশাপাশি গ্রীক, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বিভিন্ন দেব দেবীর বর্ণনা ও ভাস্কর্য এবং দেব-দেবী সম্পর্কিত নানা অলীক বিশ্বাস তুলে ধরে পৌত্তলিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ বিহার, হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রতিমার বহু ছবি দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধস্তূপে ভক্ত ও উপাসনাকারীদের ছবিও রয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো মসজিদ কিংবা মুসলিম নিদর্শনের ছবি ও বর্ণনা নেই। বাস্তব কিংবা কল্পিত ছবি ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবিই বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা এই বইয়ে ছেলে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে নির্লজ্জ বর্ণনা রয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অত্যন্ত বেমানান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের যৌথ ক্লাসে বেহায়াপনা শিক্ষাদানের শামিল। তাছাড়া ছেলে মেয়েদের পারস্পরিক আগ্রহ, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সংযমের শিক্ষা ব্যতীত উল্লেখ করে ফ্রি-মিক্সিং ও অবাধ যৌনতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা সমাজ ও দেশে নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে। উক্ত বইয়ে ‘বয়ঃসন্ধিকালে মনের যতœ’ অনুচ্ছেদে রাগ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম নির্দেশিত সুন্দর পদ্ধতি পরিকল্পিতভাবে পাশ কাটিয়ে ৫০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো গণনার মতো অবৈজ্ঞানিক কল্পিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।

জীবন ও জীবিকা এই বইয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের জীবনাচার অনুপস্থিত। প্রতিদিনের কাজে মুসলিম জীবনাচারের উল্লেখ নেই, খাবারের আদব কায়দায় নেই ইসলামী শিষ্টাচার। গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ে দুর্গাপূজার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ভ্রমণের জন্য দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে যেতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি এই বইয়ে মুসলিম কৃষ্টি-কালচার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পুরো বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সংগীত, নৃত্য, অভিনয় এবং এর তাল, লয়, রস, মুদ্রা ইত্যাদি। বইটির প্রচ্ছদও ঢোল, তবলা ও মূর্তির ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বইটিতে যাত্রাপালা, সার্কাস, বাউল গান, লোকনাটক, পুতুল নাচ ও গানের অনুষ্ঠানকে আমাদের ‘সংস্কৃতির অমূল্য অংশ’ এবং ‘জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়’ বলা হয়েছে।

জামায়াতের নিন্দা : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। এ দেশের সব ধর্মের মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করে এবং তারা ধর্মীয় শিক্ষাকে মনে-প্রাণে ধারণ করে। সব ধর্মেই শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে শৈশবকালই ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের উপযুক্ত সময়। শিশু বয়সেই তাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকার এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চায়। সরকার ধর্মহীন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান চালু করে মানুষকে অধার্মিক, অনৈতিক ও পাপাচারে নিমজ্জিত নাগরিক তৈরি করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্মহীন শিক্ষা কোনো শিক্ষাই নয়। এটা হলো কুশিক্ষা, যা মানুষকে ধীরে ধীরে নৈতিকতা বিবর্জিত অন্যায়ের দিকে নিয়ে যাবে। ফলে দেশ সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, জিনা-ব্যভিচার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ও পাপাচারে ভরে যাবে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে। সরকারের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কোনোক্রমেই মেনে নেবে না। এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। আমরা সরকারের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

ইসলাম বিরোধী পাঠ্যপুস্তক বাতিলের দাবি হেফাজতের: দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে ষড়যন্ত্র ও আলেম-ওলামাদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে হাজির করার বিষয়ে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহাম্মাদ ইয়াহহিয়া ও মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মুসলমানের সন্তানদের ইমান আকিদা ও দেশপ্রেম ধ্বংসের জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব ইসলাম বিরোধী শক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানের সন্তানদের নাস্তিক ও হিন্দুত্ববাদী মানসিকতা তৈরি করার জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষা সিলেবাসের পরতে পরতে নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডারউইনের কুখ্যাত নাস্তিক্যবাদ ও আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস। বানর থেকে মানুষ সৃষ্টির কুরআন-হাদীস বিরোধী মতবাদ পাঠ্যবইয়ে সংযোজন করা হয়েছে। হিজাব থেকে শুরু করে দাড়ি ইসলামের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার বিষয়ে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে।

তারা বলেন, আমাদেরকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছিলো পাঠ্য বইয়ে ইসলাম বিরোধী কিছু থাকবে না। কিন্তু সেই কথা রাখা হয়নি। সর্বোচ্চ মহলের কাছে দাবি জানানোর পরেও ইসলাম বিরোধী মতবাদগুলো কেন পাঠ্যবইয়ে থাকলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

হেফাজত নেতারা বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীদের হাতে ইসলামবিদ্বেষী এসব বই-পুস্তক তুলে দেয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা জানতে চাই, কারা এহেন গুরুতর অপকর্ম করেছে? তাদের সামনে আনা হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। একই সাথে এই শিক্ষা সিলেবাসে থাকা ইসলাম বিরোধী বিষয়গুলোসহ অসঙ্গতিপূর্ণ সকল বিষয় বাতিল করে নতুন সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। এই সিলেবাসে একদিনও পাঠদান আমরা মেনে নিতে পারি না।

তারা বলেন, হেফাজতে ইসলামের মামলায় কারাবন্দী আলেম-ওলামাদের আদালতে হাজির করার সময় সম্পূর্ণ বে আইনিভাবে ডান্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে। এই ঘটনা শুধু অমানবিক যে তা নয়, বে আইনিও। এইভাবে আলেমদের লাঞ্ছিত করা কারো জন্য শুভ হবে না। আলেমরা দেশের শত্রু বা সন্ত্রাসী না। তাদের এভাবে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে তোলা চরম অমানবিক।

খেলাফত আন্দোলনের বিক্ষোভ: বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন কোরআন- হাদীস বিরোধী বিতর্কিত সিলেবাস বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে খেলাফত আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। গতকাল বাদ জুমা রাজধানীর কামরাংগিরচরে ইসলাম বিরোধী সিলেবাস বাতিলের দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান। মিছিলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজি। মিছিল শেষে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন দলের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন, প্রচার সম্পাদক মাওলানা সাইফুল ইসলাম সুনামগঞ্জী প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজি বলেন, বিতর্কিত সিলেবাসের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক ও পৌত্তলিক বানানোর ষড়যন্ত্র এদেশের তাওহীদ জনতা মেনে নিবে না। সরকার যদি দাবি মানতে ব্যর্থ হয় তাহলে আন্দোলন থামবে না এবং জনগণ সঠিক সময়ে সঠিক জবাব দিবে।

মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ৯২ ভাগ মুসলমান এ দেশের পাঠ্য পুস্তকে ডারউইনের মতবাদ দেখতে চায় না। কতিপয় নাস্তিক ব্যতীত সমগ্র সাচ্চা মুসলমান ও গোটা জাতি বিশ্বাস করে আমরা আদম সন্তান, বানরের প্রজাতি নয়।

মাওলানা হামিদী বলেন, পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) থেকে মানুষের সূচনা । এ বিশ্বাস না থাকলে ঈমানহারা হয়ে যাবে। পাঠ্য পুস্তক থেকে ডারউইনের বানর থিওরি নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদি পাঠসমূহ বাদ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আক্বীদা বিশ্বাস ও ধর্মীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাঠ্যবই প্রণয়নের জোর দাবি জানান তিনি।

মুফতি সুলতান মহিউদ্দিন বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞান বইএ নগ্ন ছবি, মুর্তিসহ ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও হিন্দুত্ববাদ সংযোজন করে মুসলিম সন্তানদেরকে নাস্তিক বানানোর চক্রান্ত চলছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাস্তিক্যবাদী একটি মহল ঘাপটি মেরে বসে আছে। ৯২ ভাগ মুসলমানদের বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে মন্দিরের ছবি থাকতে পারে না। বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় তাওহিদী জনতা ইসলাম বিরোধী এই সিলেবাস কিছুতেই মেনে নিবে না। অবিলম্বে এই সিলেবাস বাতিল করতে হবে। অন্যথায় গণআন্দোলন সৃষ্টি হবে।

মাওলানা সাইফুল ইসলাম সুনামগঞ্জী বলেন, পবিত্র কুরআন হাদিসে স্পষ্ট লেখা আছে আদি পিতা হযরত আদম আঃ থেকেই মানব জাতির বংশ বিস্তার হচ্ছে। ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব সম্পুর্ন কোরআন বিরোধী। কোন বিবেকবান মানুষ নিজেকে বানরের জাতি পরিচয় দিতে পারেনা। অবিলম্বে বিতর্কিত সিলেবাস বাতিল করতে হবে। অন্যথায় আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

চরমোনাই পীর : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী দেশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু ইসলাম বিরোধী সিদ্ধান্ত এবং দুর্নীতির কারণে জনগণের মনে স্থান করে নিতে পারে নাই। নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক ও ধর্মহীন করার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে সিলেবাসে নাস্তিক্যবাদী শিক্ষা সংযোজন করেছেন। শিক্ষা সিলেবাস থেকে ডারউইনের মতবাদ বাদ দিতে হবে। হিন্দুত্ববাদী শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, বিধর্মীরা কুরআনুল কারীম রিসার্চ করে মুসলমান হচ্ছেন কিন্তু মুসলমানরা কুরআন ও কুরআনী শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।

চরমোনাই’র পীর সাহেব আরো বলেন, একশ্রেণির মুসলমান সন্তানদের কার্যক্রম দেখলে মনে হয় তারা নাস্তিক ও মুরতাদ হবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসতে হবে। নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ ক্রমেই নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী শিক্ষাকে অবজ্ঞার কারণে এমনটি হচ্ছে।

ছাত্রশিবিরের নিন্দা : ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ইসলামী শিক্ষা উপেক্ষা এবং ইসলামবিরোধী বিষয় সংযুক্তির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। একই সাথে অবিলম্বে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। যৌথ ওই বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জেনারেল মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামী আদর্শ মুছে দিয়ে অশ্লীলতা, পৌত্তলিকতা শিক্ষা সংযুক্তির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করছে সরকার। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ২০২৩ সালের নতুন শিক্ষাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির বইয়ে ইসলামী শিক্ষা উপেক্ষা করে ইসলামবিরোধী বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।

৬ষ্ঠ শ্রেণির ১০টি বইয়ের মধ্যে ৯টি বইয়েই অত্যন্ত সুকৌশলে ইসলামী বিশ্বাস, আদর্শ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা ও ইসলামবিরোধী ভিনদেশী কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরা হয়েছে। ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে চরম ইসলামবিরোধী, বিতর্কিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রত্যাখ্যাত ‘বিবর্তনবাদ’ সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি এ বইয়ে অসংখ্য কল্পিত দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি প্রকাশের মাধ্যমে পৌত্তলিকতা ও অশ্লীলতা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। বইটিতে উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন অর্জনে বিতর্কিত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কর্মকা-কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে ধরলেও মুসলিমদের ত্যাগী ও ঐতিহাসিক ভূমিকাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

‘বিজ্ঞান’ বইয়ে পৌরাণিক কাহীনি উল্লেখ করে বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বইটিতে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে বিভিন্ন লজ্জাস্থানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে বয়ঃসন্ধিকালের নির্লজ্জ বর্ণনা ও বিকৃত, অবাধ যৌনতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। বইগুলোতে মুসলিম ও বাংলাদেশী সুস্থসংস্কৃতি উপেক্ষা করে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য নগ্ন সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সুকৌশলে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রবেশ করানো হয়েছে। এ পাঠ্যপুস্তুক শুধু ইসলামবিরোধীই নয়; বরং সরাসরি ইতিহাস বিকৃত ও দেশের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শামিল। মুসলমান দূরে থাক; কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ এ বিকৃত, নির্লজ্জ, উদ্ভট, বানোয়াট, কল্পিত বিষয়ে পরিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক মেনে নিতে পারে না।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ২০১০ সালে বিতর্কিত ইসলামবিমুখ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার পর থেকেই ধর্মহীন এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে দেশের আলেমসমাজ, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও ইসলামপ্রিয় ছাত্র-জনতা। ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে বিকল্প প্রস্তাবনাও সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু এসব দাবি ও সংশোধনীর প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে সরকার বিশেষ অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছে। আমরা হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, ইসলামপ্রিয় ছাত্র-জনতা নাস্তিক্যবাদী এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেবে না। সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, মতামত ও ন্যায়সংগত দাবিকে মূল্যায়ন করতে হবে। অন্যথায় জনদাবিকে অবমূল্যায়ন করার খেসারাত দিতে হবে। আমরা অবিলম্বে এ নীতিহীন সিদ্ধান্ত বাতিল করে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

https://dailysangram.com/post/514327