২০ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১১:১৯

রোজায় পণ্য আনতে এবার অনেক ঝক্কি

রমজানে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ছোলা, তেল, খেজুরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় আট পণ্যে বিশেষ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছিল। আমদানির পর দাম পরিশোধের অনুমতি দেওয়ার ঘোষণা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আমদানির ৯০ দিনের মধ্যে ব্যবসায়ীরা এলসির (ঋণপত্র) বিপরীতে এসব পণ্যের দাম পরিশোধ করতে পারবেন বলে গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিজ্ঞপ্তিও জারি করে। এর আগে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য সরবরাহের এলসি খুলতে নগদ মার্জিনের হার ব্যাংক-গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে নূ্যনতম পর্যায়ে রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। রমজানের পণ্য আনতে একের পর এক বাধা ডিঙাতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে ডলার। এর মধ্যে বেড়ে গেছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও। তাই উৎপাদনে কেউ কেউ টানছেন লাগাম। দেশের প্রধান পাইকারি মোকাম চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এখনই চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না পণ্য। রমজানের দুই মাস বাকি থাকতে মোকামেই প্রতিটি পণ্যের দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে গেছে।

শীর্ষ আমদানিকারকদের মধ্যে যাঁরা এলসি খুলে পণ্য এনেছেন তাঁদের অনেকে ডলার সংকটে সেই চালান খালাস করতে পারছেন না। আবার মাঝারিমানের আমদানিকারক যাঁরা আছেন তাঁরা ডলার সংকটে এখনও খুলতে পারেননি এলসি। এ জন্য এলসি ও আমদানি উভয়ের পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এবার অনেক কমে গেছে। সর্বশেষ তিন মাসে গতবারের একই সময়ের তুলনায় এবার ছোলা ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ৪৭ শতাংশ, অপরিশোধিত চিনি ২৮, খেজুরের এলসি ৩০ শতাংশ কম হয়েছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরেও। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে প্রতি বছর এ সময়ে রমজানের পণ্যবোঝাই দেড় ডজনেরও বেশি জাহাজ থাকে। তবে এখন বন্দরে রমজানের পণ্যবোঝাই জাহাজ রয়েছে মাত্র ৮টি। এর মধ্যে অপরিশোধিত চিনিবোঝাই জাহাজ রয়েছে তিনটি। তিনটি ছোলা, ডাল ও ভুট্টার জাহাজ। আর সয়াবিন তেলবোঝাই জাহাজ আছে দুটি। অথচ রমজানের পণ্য সাধারণত দুই মাস আগে এনে তা প্রক্রিয়াজাতের জন্য পাইকারি বাজারে সরবরাহ করেন আমদানিকারকরা। বন্দরে এবার সেই চেনা ছবি নেই।

বিপদ আঁচ করতে পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার রমজানের আট পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নতুন করে নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এই বৈঠকে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। যে আট পণ্যের এলসি খুলতে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে- ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মশলা, চিনি ও খেজুর।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, 'রমজানে সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে সেজন্য আগেভাগে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তারপরও এলসি খোলার হার আগের তুলনায় কিছুটা কম। আশা করছি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পর্যাপ্ত এলসি খুলবেন ব্যবসায়ীরা। রমজানের এখনও দুই মাস বাকি থাকায় হয়তো কেউ কেউ এখনও বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। সরবরাহ ঠিক রাখার পাশাপাশি রমজানে নিত্যপণ্যের দামও যাতে স্থিতিশীল থাকে সে জন্য ৪ জানুয়ারি টাস্কফোর্সের সভা হয়েছে। সেই সভায় এলসি খোলার হার আরও বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত পণ্য আছে। বিশ্ববাজারও স্থিতিশীল আছে। তাই রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না।'

ডলার নিয়ে টেনশন :দেশের বৃহত্তম দুই পাইকারি মোকাম হচ্ছে ঢাকার মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এ দুটি মোকাম থেকেই পণ্য যায় সারাদেশে। এই সময়ে জমজমাট থাকার কথা পাইকারি মোকাম। তবে খাতুনগঞ্জে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে উল্টো ছবি। এখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাগুলোতেও নেই এলসি খোলার ব্যস্ততা। ব্র্যাক, যমুনা ও অগ্রণী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ডলার সংকটে চাহিদা মতো এলসি খুলতে পারছেন না তাঁরা। ব্যবসায়ীরা যে অঙ্কের এলসি চাচ্ছেন তার চেয়ে কম খুলতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ডলার না পাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ডলার সংকট নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিধিনিষেধও দেওয়া আছে বলে জানালেন তাঁরা। এ জন্য স্বনামে বক্তব্য দিতে রাজি হননি ব্যাংক কর্মকর্তাদের কেউই।

ডালের এলসি করতে আসা ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদের সঙ্গে কথা হয় যমুনা ব্যাংকের একটি শাখায়। তিনি বলেন, 'রমজানের আগে পণ্য আনতে হলে এখনই এলসি করতে হবে আমাকে। তবে আমার যত ডলারের এলসি দরকার তার অর্ধেক দিতে রাজি হচ্ছে ব্যাংক। এ জন্য এখনও এলসি খোলা হয়নি। কবে পণ্য আনতে পারব জানি না।'

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কমছে সরবরাহ :খুচরা দোকানে রমজানের ১৫ দিন আগে থেকে জমে ওঠে বেচাকেনা। তবে পাইকারি মোকামে এটি শুরু হয় রমজানের অনেক আগে। মাঝারিমানের দোকানগুলো এ সময়ে পাইকারি মোকামে পণ্যের চাহিদা দিয়ে রাখে। কিছু পণ্য খালাস করে আর কিছু পণ্য গুদামে রাখে তারা। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় খাতুনগঞ্জে কমেছে পণ্য সরবরাহ। বিদেশ থেকে আনা অপরিশোধিত তেল ও চিনি দেশীয় কারখানায় পরিশোধন করতে হয়। এরপর এগুলো পাইকারি মোকামে সরবরাহ করেন আমদানিকারকরা। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখনই উৎপাদনে লাগাম টেনেছেন মিলমালিকরা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের নতুন দর কার্যকর করার কথা থাকলেও এখনই চাহিদামতো তেল ও চিনি মিলছে না বলে জানালেন খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তেল ও চিনি পরিশোধন করা এক আমদানিকারক বলেন, 'এক সপ্তাহ আগেই বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। এখন এলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা। এলসিও খুলতে পারছি না চাহিদামতো। পণ্য দেশে আনার পরও ডলার সংকটে তা খালাস করতে পারছি না। পদে পদে এত বাধা থাকলে কীভাবে ঠিক রাখব সরবরাহ।'

এখনই বাড়ছে দাম : রমজানের দুই মাস বাকি থাকলেও এখনই দাম বাড়ছে তেল, চিনি, ছোলাসহ রমজানের প্রতিটি পণ্যের। ভোজ্যতেলের পাইকারি বিক্রেতা সাহেদ উল আলম জানান, সপ্তাহ ঘুরতেই মণপ্রতি ১০০ টাকা বেড়েছে চিনি ও তেলের দাম। মণপ্রতি পামঅয়েল এখন ৪ হাজার ৫৫০ টাকা ও সয়াবিন ৬ হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৮৫০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে সব পণ্যের দাম মণে ১০০ টাকা কম ছিল। এলসি কম হওয়া ও কারখানা থেকে চাহিদামতো পণ্য না পাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ড্রাস্টিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগির আহমদ বলেন, 'পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করতে হলে এখনই ডলার সংকট দূর করতে হবে। চাহিদার সঙ্গে জোগান ঠিক না থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার সুযোগ নেবেন। সরকার রমজানের পণ্য আনতে যে এলসি সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তা বাস্তবে কার্যকর করতে হবে।'

গতবারের চেয়ে অর্ধেক এলসি :২০২২ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রমজানের বিভিন্ন পণ্যের এলসি প্রায় অর্ধেক কম খোলা হয়েছে। এটাকে অশনিসংকেত বলে মনে করা হচ্ছে। তবে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এখনও এলসি খুলে রমজানের পণ্য আনার সময় আছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'আসন্ন রমজানে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও স্বাভাবিক রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংকট কিছুটা কমলেও ডলার এখনও চাহিদামতো মিলছে না। রমজানের পণ্য নিয়ে আসা পাঁচটি জাহাজ দিনের পর দিন চট্টগ্রাম বন্দরে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংক রপ্তানিকারককে ডলার দিতে না পারায় পণ্য খালাস করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। বড় ব্যবসায়ীরা কিছু এলসি খুললেও মাঝারিমানের ব্যবসায়ীদের নানা প্রশ্ন করছে সংশ্নিষ্ট ব্যাংক। অথচ ছোলা, তেল, খেজুরসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় আট পণ্য আমদানির পর মূল্য পরিশোধের অনুমতিও দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও কেন ডলারের অজুহাতে এলসি খুলতে গড়িমসি করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।'

https://samakal.com/whole-country/article/2301152210