১০ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:৪৯

কাগজ নিয়ে বহুমুখী সংকটের আশঙ্কা

বছরে ৭ লাখ মেট্রিক টন কাগজের চাহিদা, কিন্তু পাল্প নেই


 জোড়াতালি দিয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির অধিকাংশ পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শেষের পথে। কিন্তু এবার সংকট শুরু হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে পরবর্তী স্তরের পাঠ্যবই নিয়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের সহায়ক (নোট-গাইড) বই ছাপার কাজও অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ২০ দিন পর অমর একুশে বইমেলা শুরু হবে। গল্প-উপন্যাসসহ ওই মেলার সৃজনশীল গ্রন্থ মুদ্রণও সংকটে পড়েছে। এমনকি ছাত্রছাত্রীদের লেখার জন্য খাতা-কাগজ পাওয়া যাবে কিনা-সেই সংশয়ও সামনে এসেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রকাশকরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংকট সমাধানের কোনো পথ বের হয়নি।

সরকারি সংস্থাগুলো সংকট মেটাতে মধ্যস্থতার ভূমিকায় নেমেছে। এমন পদক্ষেপের অংশ হিসাবেই সোমবার দুটি বৈঠক হয়। সকালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) উচ্চ মাধ্যমিকের ৫টি সরকারি বইয়ের দর নির্ধারণের বৈঠক হয়। আর বিকালে প্রতিযোগিতা কমিশনে কাগজের দর, পাল্পের বিদ্যমান অবস্থা এবং শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানি ইত্যাদি বিষয়ে বৈঠক করে। কিন্তু সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে উভয় বৈঠক। এছাড়া প্রতিযোগিতা কমিশন আগামী বৃহস্পতিবার এনসিটিবির সঙ্গে বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মূলত বইয়ের দর নির্ধারণের ব্যাপারে কমিশনের হস্তক্ষেপ চেয়ে প্রকাশকরা আপিল করায় এনসিটিবির সঙ্গে এই বৈঠক করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. এএফএম মনজুর কাদির যুগান্তরকে বলেন, কাগজ পরিস্থিতি নিয়ে আজ (সোমবার) মিল মালিক এবং প্রকাশকদের সঙ্গে বৈঠক ছিল। কাগজ মালিকরা জানিয়েছেন, কাগজের প্রধান কাঁচামাল পাল্পের সংকট আছে। আমদানিনির্ভর এই পণ্যের জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। তাছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ আর করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে পাল্পের দাম বেশি। তাই দেশের বাজারে কাগজের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে প্রকাশকরা কাগজ সংকট সমাধানে তা আমদানির দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, শুল্কমুক্ত আমদানির রাস্তা খুলে না দিলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আজকে কেবল সাদা কাগজ উৎপাদনকারী মিলের মালিকরা এসেছিলেন। এখন এ সপ্তাহের মধ্যেই নিউজপ্রিন্ট কাগজের মিলের মালিকদের নিয়ে আমরা বসব। এরপর কাগজের দর এবং আমদানি সংক্রান্ত একটি সুপারিশ পাঠানো হবে।

অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের দর নির্ধারণ সংক্রান্ত বৈঠক সম্পর্কে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কাগজ-কালিসহ অন্যান্য মুদ্রণ সামগ্রীর বাজার যাচাই করেই এনসিটিবি বইয়ের দর ঠিক করে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এবার উচ্চ মাধ্যমিকের সরকারি ৫টি বইয়ের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা প্রকাশকদের জানানো হয়। কিন্তু তারা এতে রাজি হয়নি। এখন বোর্ড বৈঠক করে এ ব্যাপারে প্রকাশকদের সিদ্ধান্ত জানাবে।

সূত্র জানায়, সোমবার সকালে এনসিটিবিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ৫টি বই-বাংলা, ইংরেজি, বাংলা নাটক ও উপন্যাস এবং আইসিটি বইয়ের দাম নির্ধারণী বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রকাশকরা প্রতি ফর্মার দর ২৭ শতাংশ বাড়ানোর দাবি জানান। পাশাপাশি তারা এনসিটিবি থেকে অনুমোদন নেওয়া এই স্তরের অন্য সব বইয়ের দাম ২৭ শতাংশ বাড়ানোর ব্যাপারে প্রকাশক সমিতির নেওয়া সিদ্ধান্তও এনসিটিবিকে অবহিত করেন। কিন্তু এনসিটিবি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর ব্যাপারে অনড় থাকে। বিপরীত দিকে প্রকাশকরাও তাদের দাবিতে অনড় থাকে। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়।

সূত্র জানায়, প্রকাশকরা বৈঠকে আরও কিছু দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-নোট-গাইড ছাপা কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের বইয়ের মুদ্রণ কাজ শেষ করার স্বার্থে এনসিটিবি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নোট-গাইড না ছাপতে প্রকাশকদের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিনামূল্যের বই ছাপানো শেষ হয়নি। তাই ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকার ওই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়। প্রকাশকরা এটি ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণের অনুরোধ করে। শেষ পর্যন্ত এনসিটিবি এই দাবি মেনে নিয়েছে। এছাড়া নকল ঠেকাতে এইচএসসির ২০২৩ সালের বইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তন, ক্লাস শুরুর এক সপ্তাহ আগে (২৩ জানুয়ারি) বই বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়াসহ আরও কিছু দাবি করেন প্রকাশকরা। এসব দাবিও এনসিটিবি মেনে নিয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রতিযোগিতা কমিশনে বৈঠক : এদিকে বাজারে কাগজ সংকট, কাগজের চড়া দাম, সংকট উত্তরণে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ প্রদানসহ কয়েকটি ইস্যুতে বিকালে প্রতিযোগিতা কমিশনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে একদিকে ছিলেন মিল মালিকরা। অন্যদিকে ছিলেন প্রকাশকরা। সূত্র জানায়, বৈঠকে মিল মালিকরা বলেছেন, দেশে বছরে নিউজ ও হোয়াইট প্রিন্ট মিলিয়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন কাগজ দরকার। বাজারে পাল্পের স্বল্পতা আছে। তাই তারা চাহিদা অনুযায়ী কাগজ তৈরি করতে পারছেন না। এছাড়া জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট উৎপাদন বিঘ্নিত করছে। ডলার ব্যয়ে সাশ্রয়ী নীতির কারণে তারা এলসিও খুলতে পারছেন না। এরপরও একটি মিলের প্রতিনিধি বৈঠকে জানান, সম্প্রতি তারা একটি এলসি খুলেছেন। তার বিপরীতে ৮ হাজার মেট্রিক টন পাল্প আসছে।

এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকাশকরা দাবি তোলেন, এনসিটিবির বই ছাপাতে কাগজের চাহিদা ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন। আরও ৫ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন কাগজ লাগবে। দেশীয় মিলের কাছে পাল্প নেই। তাছাড়া তাদের যে উৎপাদন ক্ষমতা তাতে পাল্প আমদানি করে রাতারাতি বাজারের কাগজ চাহিদা বা সংকট মেটানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে ২০ দিন পর অমর একুশে বইমেলা শুরু হবে। তাই এখনই জাতীয় ম্বার্থে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন মিল মালিকরা।

পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) সহসভাপতি শ্যামল পাল ওই বৈঠকে যোগ দেন। তিনি বলেন, এনসিটিবির ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন কাগজের চাহিদাই দেশীয় মিলগুলো এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারেনি। এখনো অনেক বই মুদ্রণ বাকি আছে। এখন সামনে উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের বই মুদ্রণ বাকি। এসব বই বেশিরভাগ নিউজপ্রিন্টে ছাপানো হয়। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখার খাতা এবং একুশে বইমেলার বই সাদা কাগজে ছাপানো হয়। এই দুই কাজের জন্য কাগজের দরকার। তাই জাতীয় স্বার্থে কাগজ আমদানির সুযোগ তারা চেয়েছেন। সুযোগ দেওয়া না হলে জনগণ জিম্মি হয়ে যেতে পারে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. এএফএম মনজুর কাদির যুগান্তরকে বলেন, তারা উভয়পক্ষের কথা শুনেছেন। এখন নিউজপ্রিন্ট মিলের মালিকদের কথা শুনবেন। এছাড়া ১২ জানুয়ারি এনসিটিবির সঙ্গেও তারা বসবেন। এরপর সবার বক্তব্য আর বাজার এবং চাহিদা পর্যালোচনা করে সুপারিশ করবেন যাতে সংকট সমাধান হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/633293