৯ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১২:২১

আরো নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

দূতাবাসগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র‌্যাব) পর বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা নেই বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ বারবার আশ্বস্ত করে এলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত নয়। বরং সরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির ওপর একই প্রেক্ষাপটে বা অন্য কারণে আরো নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করছেন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কূটনীতিকরা। নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও হাইকমিশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

গত ৩১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বিদেশে বাংলাদেশের মিশন প্রধানদের কাছে এই নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে ২০২৩ সালের জন্য রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের জন্য যে সাতটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশের ওপর অধিকতর নিষেধাজ্ঞা ঠেকানো এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রেখে মিশনের দৈনন্দিন কাজ এগিয়ে নেয়া। পরদিন ১ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ মিশন প্রধানদের সাথে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা হলে ঢাকার নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে এর বিরুদ্ধে সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য রাষ্ট্রদূতদের আহ্বান জানান।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে র‌্যাব ও এর সাবেক ও বর্তমান সাত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র আকস্মিকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলে বাংলাদেশ অভিযোগ করছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সরকার বারবার অনুরোধ জানালেও যুক্তরাষ্ট্র পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, এ জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, যা দীর্ঘ। নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আগাম তথ্য জানাতে ব্যর্থতার কারণে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামকে সরিয়ে দেয়া হয়।

বিশ্বে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের দেয়া পররাষ্ট্র সচিবের নির্দেশনামূলক চিঠিতে বলা হয়েছে, আমাদের একটি বিশেষায়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতিসাধনের উদ্দেশে সরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির ওপর একই প্রেক্ষাপটে বা অন্য কারণে আরো নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ জন্য নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে প্রস্তুত থাকার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি সময় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। সময়ে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আপনাদের হালনাগাদ তথ্য ও নির্দেশনা দেবে। এতে আরো বলা হয়, যেকোনো কূটনীতিক মিশনের মৌলিক কাজ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন কাজ এগিয়ে নেয়া। তবে বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আরো বাড়তি কাজের চাহিদা রয়েছে।

বছরের প্রথম দিন বাংলাদেশ মিশন প্রধানদের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক সম্পর্কে পরদিন সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কেউ যদি মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দেয়, তখন বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা ঢাকার নির্দেশের অপেক্ষা করবেন না। রাষ্ট্রদূতরা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার তাদের ওপর সর্বোচ্চ দায়িত্ব দিয়েছে। তাই কেউ যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেয়, তবে সাথে সাথে রাষ্ট্রদূতদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য বলা হয়েছে। এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিদের্শনার প্রয়োজন নেই।
ড. মোমেন বলেন, এতদিন ধরে রাষ্ট্রদূতরা যেটি করে আসছেন, সেটি হচ্ছে তারা নেতিবাচক প্রচারণায় প্রতিক্রিয়া দেখান না বা বিষয়টি সদর দফতরে অবহিত করেন না। ঢাকা যদি বিষয়টি জানতে পারে, তখন তাদের জানানো হয় এবং নির্দেশ দেয়া হলে তারা প্রতিক্রিয়া দেখান। এখন থেকে রাষ্ট্রদূতরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত খারাপ কিছু হলে আমাদের জানাতে চান না, লজ্জা পান। আমি বলেছি, লজ্জার কোনো কারণ নেই। ভালো হলেও বলবেন এবং খারাপ হলেও বলবেন। আপনারা পরিপক্ব কর্মকর্তা। অনেক বছর চাকরি করার পরে রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। আপনাদেরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সরকারের জন্য অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জল্পনা রয়েছে। তা ছাড়া সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াশিংটনের গভীর উদ্বেগ সরকারের জন্য নতুন অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সমন্বয় সভা হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। বৈঠকে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লুর আসন্ন সফর, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সবাই যাতে একই সুরে কথা বলেন তার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বৈঠক থেকে আইনের শাসন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার মোকাবেলায় একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী ১৪ জানুয়ারি ঢাকা আসছেন। এই সফরে বাইডেন প্রশাসনের অগ্রাধিকারের থাকা দু’টি ইস্যু মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব দেয়া হতে পারে। এ ছাড়া সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনসহ ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পেতে পারে।

ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরটি সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে। গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানীর শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়িতে মায়ের ডাক নামের একটি সংগঠনের সাথে মতবিনিময় শেষে বেরিয়ে আসার সময় বাইরে একদল মানুষ তাকে ঘিরে ধরার চেষ্টার ঘটনাটি পরদিন ওয়াশিংটনে আলোচনা হয়েছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানের সাথে আলোচনায় পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন ডোনাল্ড লু। বৈঠকে মোহাম্মদ ইমরান ঘটনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেন। একইসাথে তিনি রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার নিশ্চয়তা দেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/719075