৮ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ৯:৪৪

শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগী


শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগী। হাসপাতালগুলোতে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও কর্মরতদের। শীতের কারণে শেখ হাসিনা বার্র্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটসহ বার্ন ইউনিটগুলোতে বেড়েছে দগ্ধ রোগী। বার্ন ইনস্টিটিউটে ঠাঁই নেই অবস্থা। আড়াই বছরের ছোট্ট শিশু রাবেয়া খাতুন। দগ্ধ শরীর নিয়ে ছটফট করছে হাসপাতালের বেডে। গরম পানিতে দগ্ধ হয়েছে তার শরীর। তিনদিন ধরে শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রাবেয়া। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিচ্ছেন মা ডলি আক্তার। তিনি বলেন, মেয়েটি পোড়া শরীরের যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

সারারাত ঘুমাতে পারছে না। গোসলের জন্য রাখা গরম পানিতে তার শরীর পুড়ে যায়। মিরপুরে একটি বাসায় ভাড়া থাকি। ওর চাচার জন্য পাতিলে গরম পানি করে রান্নাঘরে রাখা হয়। এ সময় আমি রান্নাঘর থেকে পাশের রুমে যাই। কিন্তু রাবেয়া সেখানে খেলতে খেলতে চলে যায়। তখন পানিতে পুড়ে যায় তার শরীর। এরপর মেয়ের চিৎকার শুনে ছুটে যাই রান্না ঘরে। দেখি তার এই অবস্থা। এরপর মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। শরীরের কোমরের নিচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছে।

শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, হাসপাতালটির ৫০০ শয্যার একটিও খালি নেই। দগ্ধ রোগী প্রতিমাসে ১৮০০ থেকে ১৯০০ জন আসছে। সাধারণ সময়ে যেটি ছিল ৪০-৫০ জন। সেটি এখন বেড়ে প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন রোগী আসছেন জরুরি বিভাগে। এবং ২৩০ থেকে ২৫০ জন রোগী আসেন বহির্বিভাগে। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, জরুরি বিভাগে পোড়া শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা। খালি নেই কোনো শয্যা। গ্যাসসিলিন্ডার, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ অন্য আগুনে দগ্ধ রোগীদের পাশাপাশি তীব্র শীতের মধ্যে রান্নার চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ পাতিলে রাখা গোসলের গরম পানিতে দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধ সব রোগীর ২৫ শতাংশের নিচে পোড়া নেই। বার্ন ও প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, বছরে আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক আগুনে পুড়ে যায়। প্রতিবছরই এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। শীত আসলে এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায় ৩০ শতাংশ। গত তিন মাসে ১ হাজার করে দগ্ধ রোগী বেড়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ অনেকেই এই দুর্ঘটনার শিকার হন। তবে শিশুদের সংখ্যা বেশি। গত এক বছরে শুধু বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৩ হাজার ২৪৫ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৪৫ হাজার এবং নারী ৩৮ হাজার ২৪৫ জন। জানুয়ারিতে ৫ হাজার ৯৪৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫ হাজার ৯৪১ জন, মার্চে ৬ হাজার ৫০ জন, এপ্রিলে ৪ হাজার ৪৭০ জন, মে ৪ হাজার ৮৭৭ জন, জুনে ৫ হাজার ৪৮০, জুলাই ৫ হাজার ৬৪, আগস্টে ৫ হাজার ৯৩৮, সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ৭৮৩, অক্টোবরে ৬ হাজার ৬৯৯, নভেম্বরে ৬ হাজার ৩৬৪, ডিসেম্বরে ৬ হাজার ৯৮ জন। মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৪২৮ জন। তারমধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৭৩৭ এবং নারী ২ হাজার ৬৯১ জন।

এদিকে ঢাকা মেডিকেলেও দগ্ধ রোগীদের ভিড় দেখা গিয়েছে। সেখানে কথা হয় তাবাস্‌সুমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বোনের মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। সকালে তার মা গোসলের জন্য গরম পানি রেখে দেয় বাথরুমের সামনে। আমার ভাগ্নি পাতিলের পাশে পা দিলে তার শরীরে পানি ছিটে আসে। এরপর চিৎকার দিলে আমরা গিয়ে দেখি তার শরীর পুড়ে গেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, শীতের সময় আগুনে পোড়া রোগী বাড়ে। অনেকে গোসল করার সময় গরম পানি পাতিলে করে গোসলখানায় নিতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এই পানি পাতিলে না নিয়ে বালতিতে নিলে এমন দুর্ঘটনা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায়। আবার অনেকে আগুন পোহাতে বসে চুলার পাশে বা খড়কুটা জ্বালিয়ে। এসময় অসর্তক থাকেন। তাদের সচেতন হওয়া উচিত। এসব বিষয়ে মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। পোড়া রোগীদের অনেকের শ্বাসকষ্ট হয় এমনকি কিডনি ফেইলিওরও হয়। এর বাইরেও অনেক জটিলতা দেখা যায়। যদি কোনো রোগীর মাল্টিপল কো-অপারেটিভ, ডায়াবেটিস থাকে তখন কিন্তু অনেক সময় রোগীকে সেভ করা যায় না। আবার অনেকে দগ্ধ হওয়ার দুইদিন পড়ে চিকিৎসা নিতে আসে তখন কিন্তু এই রোগীগুলোকে সুস্থ করে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং।

প্রায় অসম্ভবের মতো। কারণ রোগীকে যে সময়ে চিকিৎসা দেওয়ার কথা সে সময়ে দেয়া সম্ভব হয় না। মুন্সীগঞ্জ থেকে এসেছেন আঁখি রানী। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের ১১ নম্বর বেডে মেয়ের পাশে বসে আছেন। আঁখি বলেন, গোসলের জন্য রান্নাঘরে গরম পানি রাখা ছিল। আমি তখন পাশের রুমে ছিলাম। আমার আড়াই বছরের মেয়ে রাধিকা বর্মণ নিচ থেকে দৌড়ে এসে এই পানিতে পুড়ে যায়। কোমরের নিচের অংশ পুড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আমারই ভুল ছিল। পানিটা যদি উপরে তুলে রেখে যেতাম তাহলে আর এমন হতো না। মেয়েটার অনেক কষ্ট হচ্ছে। মোখলেস শেখ বলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছি। আমার স্ত্রী শহীদা আগুনে পুড়ে যায়। সকালে কাপড় ধোঁয়ার পরে শরীর ভিজে শীতে কাঁপতে থাকে। এরপর সে শীত কমাতে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে হিট নিতে বসে। কিন্তু চুলার উপরে ওড়না পড়ে গিয়ে আগুন ধরে যায়। এতে তার শরীর পুরে যায়। ঘটনার সময় সে আর আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী বাসায় ছিল। পাশে থাকা মিস্ত্রির কাজ করা কয়েকজন ছিল। তারা চিৎকার শুনে আসে। তার পেট এবং দুইহাত বেশি পুড়ে যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে এই ঘটনা ঘটে।

শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এসএম আইউব হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের ৫০০ শয্যার একটিও খালি নেই। প্রতিদিন গড়ে ৬৫ জন রোগী আসছে জরুরি বিভাগে। প্রতিমাসে ১৮০০-১৯০০’র মতো রোগী আসছে। সেবা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ভর্তি নেওয়া হয় ১৫ জনের মতো। তাদের অনেকেরই অবস্থা খারাপ থাকে। গত কয়েক মাসে সেবা নিতে আসা রোগীদের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। শীতের তিন-চার মাসের পিরিয়ডটা আমাদের কাছে খুবই চ্যালেঞ্জিং। প্রতিদিন জরুরি বিভাগে নরমাল সময় ৪০-৫০ রোগী আসে। কিন্তু শীত এলে সেটি বেড়ে ৬০-৭০। আমাদের যেহেতু এটি ৫০০ শয্যার ইউনিট সেহেতু আমরা এই ৫০০ শয্যা পরিপূর্ণ হয়ে গেলে আর রোগী ভর্তি নিতে পারি না। তিনি বলেন, গত বছরের শেষ তিন মাসে ১ হাজার করে রোগী বাড়ছে। এই রোগীদের মধ্যে মেইনলি যে রোগীগুলো আসে সেটি হচ্ছে গরম পানিতে পোড়া। বয়স্ক থেকে শুরু করে বাচ্চারা আসে। তবে ৩-৫ বছর এবং ১-৩ বছরের বাচ্চাদের সংখ্যা বেশি। এই বয়সী বাচ্চারা কথা বললে খুব একটা শুনতে চায় না ছোটাছুটি করে। শীত এলে যেহেতু গরম পানির ব্যবহারটা বেড়ে যায় তাদেরও দগ্ধ হতে হয় বেশি। ঢাকা এবং ঢকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে। তবে ঢাকার মধ্যের রোগী বেশি।

এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালেও অসংখ্য রোগী আছে। তারা আমাদের অন্যান্য বার্ন ইউনিটে কিন্তু যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গরম পানিতে পোড়া বয়স্ক থেকে ছোট যে রোগীরা আসে তাদেরকে আমরা প্রথমদিন প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করি। শীতের সময় ঘর গরম রাখার জন্য অনেকে গ্যাসের চুলা ওপেন করে রাখে, সেই সঙ্গে সিলিন্ডার ব্লাস্ট, এসি ব্লাস্ট, আগুন পোহানো এই রোগীগুলোর প্রত্যেককে ভর্তি করানো লাগে। কারণ তাদের অধিকাংশের ২৫ শতাংশের নিচে কখনও বার্ন থাকে না। শাড়িতে আগুন ধরলে তার পিঠ সহ অধিকাংশ জায়গা পুড়ে যায়। এই রোগীগুলো ডিপ বার্ন হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে সারভাইভ করা খুব কঠিন তাদের। তাদের জীবনের ঝুঁকিও থেকে যায়। আইসিইউ ও এইচডিইউ সাপোর্ট লাগে অনেকের। অথচ আমাদের এখানে কোনো শয্যাই খালি নেই।


https://mzamin.com/news.php?news=37428