৭ জানুয়ারি ২০২৩, শনিবার, ৮:২৪

অর্থবছরের শুরুতেই বাজেট বাস্তবায়নে স্থবিরতা

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দিকের মাসগুলোতে বাস্তবায়ন অগ্রগতিতে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আগের পুরো অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের ১৪ শতাংশ বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করা সম্ভব হয়নি। টাকার অঙ্কে অবাস্তবায়িত বাজেট বরাদ্দের অঙ্ক ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। নতুন অর্থবছরে এসেও সেই বাজেট বাস্তবায়নের সেই স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাসে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে বাজেট ব্যয় হয়েছে ৪৫ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ব্যয়ের তুলনায় টাকার চলতি মূল্যে মাত্র ১.৪৯ শতাংশ বেশি। আর মার্কিন ডলারে হিসাব করা হলে বাজেট ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন কর্মসূচির অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বিবেচ্য দুই মাসে মাত্র ৫ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে, যা পুরো বছরের বরাদ্দের মাত্র ০.২৩ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সাধারণত নতুন অর্থবছর শুরুর আগের মাস জুনে বাজেট ঘোষণা করা হয়। অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে এই বাজেট বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সংশোধনের কার্যক্রম শুরু করা হয়। আর নতুন অর্থবছরের মূল বাজেট ঘোষণার একই সময়ে চলমান অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ঘোষণা করা হয়। সাধারণত সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করার সময়ে অর্থবছরের ৮-৯ মাসের বাস্তব পরিসংখ্যান ও অবশিষ্ট সময়ের সম্ভাব্য চিত্রের ওপর ভিত্তি করে সংশোধিত ব্যয় বরাদ্দের একটি হিসাব করা হয়। এক সময় বাজেটের সংশোধিত বরাদ্দের বিপরীতে বাস্তব ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান কয়েক শতাংশে সীমিত থাকত। কিন্তু গত অর্ধ দশক ধরে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। অর্থনীতিবিদরা এ জন্য দুটি কারণকে দায়ী করেন। তাদের মতে এক দিকে সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বিশেষভাবে উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশ অবাস্তবায়িত থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, সরকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার বড় অংশ অবাস্তবায়িত থাকার ফলে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সম্পদের জোগান পাওয়া যায় না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা মূল বাজেট বরাদ্দকে সংশোধিত বাজেটে ৫ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আর বাস্তবে ব্যয় হয় ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এতে বাজেট বাস্তবায়ন মূল বরাদ্দের তুলনায় ১৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কম হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে শেষ পর্যন্ত ৫ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বাজেট বাস্তবায়ন ব্যয় হয়, যা এই অর্থবছরের মূল বরাদ্দের তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রারম্ভিক মাসগুলোর পরিসংখ্যানে বাজেট বাস্তবায়নে বড় অনুপাতে ঘাটতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টের পরিসংখ্যান অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এই দুই মাসে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩.৮ শতাংশ বেশি। অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে ৩৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকাই হলো বেতন-ভাতা, সুদ এবং ভর্তুকি খাতে। যার মধ্যে বেতন-ভাতা খাতে ৯ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, সুদ খাতে ১১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা এবং ভর্তুকি ও হস্তান্তর খাতে ব্যয় হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের তুলনায় এসব খাতের ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেতন-ভাতা খাতে এ সময় ১৪ শতাংশ খরচ কমলেও সুদ খাতে খরচ বেড়েছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। যার মধ্যে ২২ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বৈদেশিক দায়দেনা খাতে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি কমে যাওয়ায় অর্থবছর শেষে সুদ খাতের ব্যয় বৃদ্ধির হার অনেক বেশি হবে। বিবেচ্য দুই মাসে ভর্তুকি ও হস্তান্তর খাতে ব্যয় ১১.৩ শতাংশ বেড়েছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন প্রবণতায় বড় রকমের নেতিবাচক প্রবণতা হলো উন্নয়ন খাতে ব্যয় হ্রাস। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সার্বিক উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের তুলনায় সাড়ে ২২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের ১২ মাসের উন্নয়ন খাতে যে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বিপরীতে দুই মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ০.২৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা মোট বরাদ্দ রয়েছে।

উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে এই দুরবস্থার একটি কারণ হতে পারে সরকারের রাজস্ব আয়ে দুর্বল অবস্থা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে আগের অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ৩৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত খাতসমূহে রাজস্ব আদায় ৩৬.২১ শতাংশ বেড়ে ৪৬ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অন্য দিকে এনবিআর বহির্ভূত কর খাতে রাজস্ব আদায় ১০৬ শতাংশ বেড়ে ১৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর পাশাপাশি কর-বহির্ভূত খাতে ২৪.৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে রাজস্ব আদায় ৮ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই দুই মাসে সরকারের মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় সাড়ে ৩৫ শতাংশের মতো বেশি।

রাজস্ব আদায়ের এই চিত্র সরকারের জন্য হতাশাজনক হওয়ার কথা নয়। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসাবে মোট রাজস্ব আদায় হয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মাত্র পৌনে ৩ শতাংশ বেশি। আদায়কৃত এই রাজস্ব ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশের মতো কম।

চলতি অর্থবছরে এনবিআর সূত্রের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের খাতসমূহে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ শতাংশের মতো বেশি। অর্থবছরের শুরুতে যেভাবে এনবিআর রাজস্ব প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছিল সেটি সরকারের আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে অনেকটাই কমে গেছে। অর্থবছরের শেষার্ধ্বে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। ফলে অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যেতে পারে।

দেশের রাজস্ব পরিস্থিতিকে বৈদেশিক খাত বড়ভাবে প্রভাবিত করছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র উল্লেখ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাজেটের বরাদ্দকৃত ব্যয় সংস্থানের দুই উৎস হলো সরকারের রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক ঋণ সহায়তা। সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে সাধারণভাবে বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তি কমে যায়। ২০২৩ সালে এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। অন্য দিকে ২০২২ সালে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে রেকর্ড ঘাটতি এবং রিজার্ভের চাপ ঠেকাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এর মধ্যে নতুন এলসি খোলার হার নেতিবাচক হয়ে পড়েছে, যার কারণে আমদানি খাত থেকে অর্থবছরের প্রথম দিকে যে হারে রাজস্ব আহরণ হচ্ছিল সে হারে ভাটা পড়েছে দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে। অর্থবছরের শেষার্ধে এ চাপ আরো বাড়বে।

এ দিকে গত ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এক বছর আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। একই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ২৩ শতাংশ কমে ১০৫.২৫ টাকায় নেমে এসেছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধির হার আরো বেশি।
বৈদেশিক খাতের মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রেমিট্যান্স ২.৪৮ শতাংশ বেড়ে সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। অন্য দিকে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে আমদানি ব্যয় ৪.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫.১৫ বিলিয়ন ডলার এবং একই সময়ে রফতানি আয় সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়ে ২৭.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবে ৫ মাসে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫.৬৭ বিলিয়ন ডলার।

বৈদেশিক খাতের চাপ ঠেকানোর জন্য সরকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, রফতানি খাত এবং কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও দারিদ্র্যের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/718554