৬ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৪:১৩

ঢাকার ৪৮ 'মৃত্যুকূপে' ব্যবসা-বসবাস

ভবনের চেহারাই বলে দেয় কী ভয়ংকর! তবু পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ মার্কেটের 'পরিত্যক্ত' ঘোষিত এই ভবনে এখনও চালু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সাজ্জাদ নয়ন। 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ৪৮ ভবন 'ঝুঁকিপূর্ণ'। এর মধ্যে রয়েছে ৯টি পরিত্যক্ত মার্কেট ভবন; আছে আবাসিক ভবনও। তবু সংস্থা দুটি নড়বড়ে ভবনে মার্কেট ও দোকান খোলা রেখে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের কাছ থেকে করপোরেশন নিয়মিত ভাড়াও আদায় করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ধসে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্বেগ নেই দুই সিটির।
শুধু তাই নয়, করপোরেশনের তরফ থেকে ওই সব ভবনের ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়, নবায়নও করা হয় পুরোনো লাইসেন্স। অন্যদিকে চিহ্নিত মার্কেট ও আবাসিক ভবনগুলোতে শুধু 'ঝুঁকিপূর্ণ' নোটিশ সাঁটিয়ে দায়িত্ব সেরেছে সিটি করপোরেশন। দুই মেয়রের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসিক ভবনে বসবাসকারী কর্মচারীদের মাসের বেতন থেকে কোয়ার্টার ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল ঠিকই কাটছে সংস্থাটি। এমনকি গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও ওই ঝুঁকিপূর্ণ কোয়ার্টারে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিপজ্জনক ভবনের তালিকায় রয়েছে তিনটি কমিউনিটি সেন্টার। সেগুলোও ভাড়া দিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশন। আরেকটি ভবনে চলছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি থানার কার্যক্রম।

জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ২০২০ সালে ৯টি মার্কেট ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৯টি বাণিজ্যিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও ভাঙার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাদের ৯টি মার্কেট ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে 'ঝুঁকিপূর্ণ' সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। এর পরও মোহাম্মদপুর টাউন হল পাকা মার্কেটে ১১০টি, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারের ৪৮৭টি, গুলশান উত্তর কাঁচা মার্কেট ও গুলশান দক্ষিণ পাকা মার্কেটের ২৪২টি, রায়েরবাজার মার্কেটের ৯৭৫টি, কারওয়ান বাজার কাঁচা মার্কেটের (কিচেন মার্কেট) ৮১৪টি, কারওয়ান বাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেটের ২৪৬টি, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর ভবন মার্কেট থেকে ৩৪০টি ও কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়ত মার্কেটের ১৭৬টি দোকানে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করছেন। কারওয়ান বাজারের মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা যায়, ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে রড বের হয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় লোহার পাইপ দিয়ে ছাদে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে।

এদিকে গত ২১ এপ্রিল ডিএসসিসি সায়েদাবাদের ধলপুরের ১০ নম্বর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টারের ২১টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে কোয়ার্টারের ১৮০ ফ্ল্যাটে বসবাসকারীদের অন্যত্র চলে যেতে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। কিন্তু বাসস্থান না থাকার কারণে গণবিজ্ঞপ্তি আমলে না নিয়ে ডিএসসিসির অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সেখানেই ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬টি ফ্ল্যাট খালি হয়েছে।

ডিএসসিসির পরিবহন পুলের গাড়িচালক সুজন মাহমুদ সমকালকে জানান, গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও ওই ঝুঁকিপূর্ণ কোয়ার্টারে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে ডিএসসিসি। গত ১০ জুন তাঁকে ১৩ নম্বর ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান আমলের এসব ভবনের কোনো কলাম নেই, রডও তেমন ছিল না। যা ছিল ক্ষয়ে গেছে। বছরখানেক আগে এই ভবনের ছাদ সংস্কারের সময় নতুন করে রড দিয়ে ঢালাই করে।

কোয়ার্টারে বসবাসরত মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, ১৪ নম্বর আউটফল স্টাফ কোয়ার্টারের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। সেখানের ৩২টি ফ্ল্যাটের ছয়টিতে এখনও কর্মচারীরা বাস করছেন। পাশেই আউটফল সুইপার বস্তিটিও ঝুঁকিপূর্ণ। সেটিতেও চলছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাস। আর দয়াগঞ্জের কানপুর ক্লিনার কলোনি ও ট্রাকস্ট্যান্ড রোডসাইড মার্কেটটি মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ দুই ভবনের নিচতলার দোকানি আর ওপর তলার বাসিন্দারা বিকল্প ব্যবস্থা নিতে ডিএসসিসির কাছে দাবি জানান। ডিএসসিসিও তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করেনি, বাসিন্দারাও আর সরেননি।

সরেজমিন বাবুবাজারের নওয়াব ইউসুফ মার্কেটে দেখা যায়, দোতলা মার্কেটটির ছাদের পলেস্তারা খসে রড বেরিয়ে গেছে, রেলিং ধসে পড়েছে। ব্যবহার অনুপযোগী কয়েকটি দোকান গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করছেন ব্যবসায়ীরা। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের কোথাও লাল সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। উল্টো সাতটি ভবনের মাঝখানের কাঁচাবাজারটি ইজারা দিতে গত ১২ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ডিএসসিসি। ওই ভবন ভেঙে পাশের কাঁচাবাজারের ওপর পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
নওয়াব ইউসুফ মার্কেটের সাত ভবনে দোকান রয়েছে ৭৩০টি। ভবনের নিচতলায় হার্ডওয়্যার, পলিথিন, লোহা-লক্কড়ের দোকান, দ্বিতীয় তলায় ব্যাগ, কার্টনের কারখানা, গার্মেন্ট আর মাঝখানে কাঁচাবাজার। পাইকারি ও খুচরা এ মার্কেটে দিনে লাখো মানুষের যাতায়াত।
নওয়াব ইউসুফ মার্কেট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, 'এ মার্কেট যে ঝুঁকিপূর্ণ আমরা তা জানি না। আমাদের কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। মার্কেটে প্রতিদিন হাজারো মানুষ কেনাকাটা করেন। সিটি করপোরেশন প্রতিবছরই নতুন করে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে। গত জুলাইয়ে ব্যবসায়ীরা ট্রেড লাইসেন্স নবায়নও করেছে। সিটি করপোরেশন প্রতি মাসে ভাড়াও নিচ্ছে।'

ডিএসসিসির আজিমপুর এতিমখানা মার্কেট, আজিমপুর কবরস্থান মার্কেট, ঠাঁটারীবাজার মার্কেট, খিলগাঁও রেলওয়ে কাঁচাবাজার মার্কেটটিও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়। তবে মার্কেটগুলো ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। এখান থেকে কেউ চলেও যায়নি। ডিএসসিসির ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আরও রয়েছে বংশাল কমিউনিটি সেন্টার, রোকনপুর কমিউনিটি সেন্টার ও ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টার। তবে এসব কমিউনিটি সেন্টারে নিয়মিত বিয়ে, জন্মদিনসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান করছেন এলাকাবাসী। এর মধ্যে বংশাল কমিউনিটি সেন্টার ভবনে কয়েকটি দোকানের সঙ্গে চলছে বংশাল থানার কার্যক্রমও।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ সমকালকে বলেন, 'কোনো বড় দুর্ঘটনার পর বা ভূমিকম্পের পর সবাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে নানা ধরনের তোড়জোড় শুরু করেন। রাজউক থেকে ভবনের নানা সার্ভে শুরু করা হয়। কিছু দিন পরই সব কার্যক্রম থেমে যায়। সিটি করপোরেশন নিজস্ব উদ্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার পর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় সিটি করপোরেশনকেই নিতে হবে। যে কোনো বড় দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুতই ভবনগুলো খালি করে ভেঙে ফেলতে হবে। না হলে যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।'

এসব বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন সমকালকে বলেন, 'ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে নোটিশ ও মাইকিং করা হয়েছে। যাতে তাঁরা এসব ভবন থেকে সরে যান। এর মধ্যে কিছু ভবন নিলামের প্রক্রিয়া চলছে, নিলাম শেষে ভেঙে ফেলা হবে।'
এসব ভবন থেকে ভাড়া আদায় ও ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, 'নোটিশ দেওয়ার পরও যেহেতু তাঁরা বাস করছেন, ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তাই তাঁদের ভাড়া বা সালামি দিতে হবে।' ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব কে নেবে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সচেতন মানুষ জেনেশুনে বিপদে পড়তে চাইলে এর দায়িত্ব কে নেবে! দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব সেখানে যাঁরা বাস করছেন তাঁদের। কারণ, তাঁদের এসব ভবন ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।'

এ ব্যাপারে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা সমকালকে বলেন, 'আমরা পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভাঙার চেষ্টা করছি। তবে কিছু মার্কেটে মামলা থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ভবনগুলো ভাঙার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা আছে।'

https://www.samakal.com/bangladesh/article/2301149807