৬ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ৪:০৩

খাদ্য সঙ্কট আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে

দেশে রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা কমছে। একই সাথে কমছে উৎপাদন ক্ষমতা। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। আর মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভাল ফসল উৎপাদন হয় না। তাই ভাল ফসল ফলানোর জন্য সুষম মাটি প্রয়োজন। সুষম মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকার কথা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হয়েছে। দেশে মোট আবাদযোগ্য এক কোটি ১৪ লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমির প্রায় ৬১ শতাংশে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। এর ফলে মাটি বছরে ৫ থেকে ৭ ভাগ খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। আর এই উৎপাদন ঘাটতি পূরণে প্রতিবারই সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। দুই বছর আগে যে জমিতে ১০ কেজি সার ব্যবহার করে ৫ মণ ধান উৎপাদন করা যেত, সেই জমিতে এখন সমপরিমাণ ধান উৎপাদন করতে ১৪ থেকে ১৫ কেজি সার লাগছে। অর্থাৎ প্রতি নিয়ত মাটি রুগ্ন হচ্ছে এবং উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদনের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কৃষি গবেষকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এক সময় কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সম্প্রতি এক জার্নালে প্রকাশিত কৃষিবিদ আবু সিদ্দিকের এক নিবন্ধে বলা হয়, রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বাংলাদেশের মাটির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাচ্ছে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে জমি। এ অবস্থায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে দেশের কৃষকরা উৎপাদন বাড়াতে রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করছে। যার ফলে দেশের মাটি ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। দেশে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের তথ্য মতে, বাংলাদেশ এ বছর ৩৫.৬৫ মিলিয়ন টন চাল সংগ্রহ করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা কম। এই প্রয়োজন মেটাতে একই জমিতে বারবার ফসল ফলানো হচ্ছে, একই সাথে চাষ হচ্ছে উন্নত ফলনশীল জাতের ধান। এসবই মাটিকে করছে দুর্বল।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে দেশের মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে জৈব পদার্থ নেই। মাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভ‚মি ধ্বংস এবং অপরিকল্পিতভাবে সারের ব্যবহারের কারণে মাটির উবর্রতা শক্তি হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের অংশ তুলে নেয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এসব কারণে মাটির স্বাস্থ্যহীনতায় এখন প্রতি বছর ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

মাটির উর্বরতাশক্তি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইন্সটিটিউট (এসআরডিআই)। তাদের ‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ›’ শীর্ষক সমীক্ষায় মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছে একই জমিতে বছরে একাধিকবার ফসল চাষ এবং মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার। আর রাসায়নিক সার বেশিরভাগই আমদানি করা হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপি সারের মূল্যের অস্থিরতার ফলে বাংলাদেশেও -এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে খাদ্য পণ্যের দাম।
এসআরডিআইয়ের মহাপরিচালক কৃষিবিদ বিধান কুমার ভান্ডার বলেন, মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরা শক্তি। জমির

উর্বরা শক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ। উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষও জমির উর্বরতা কমার কারণ। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির উৎপাদনশীলতা, মাটিতে গাছের অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানের মান বজায় রাখতে হবে। কারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে হবে। সেজন্য মাটিকে সজিব রাখতে হবে, মাটির গুণাগুণ বজায় রাখতে হবে। কৃষি জমি মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পর্দাথের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও দেশের বেশিরভাগ জমিতে জৈব পর্দাথের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে-এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম। এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে। এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব।

মাটির উর্বরা শক্তি কমার ফলে , ১৯৮০-৮১ থেকে নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম এবং ফসফরাসসহ প্রায় ধরনের পুষ্টির (সার) ব্যবহার বহুগুণ বেড়েছে। ১৯৮০-৮১ সালে ৩৬৫, ৮৮১ টন ইউরিয়া (নাইট্রোজেন) ব্যবহার করেছিল, যা ২০১৫-১৬ সালে ১,১৮৩,০২৪ টনে পৌঁছে। অর্থাৎ ত্রিশ বছরে সারের ব্যবহার তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রাসায়নিক সারের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ইউরিয়া ২৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন এবং ডিএপি ১৪ লাখ মেট্রিক টন।

https://www.dailyinqilab.com/article/546333