৬ জানুয়ারি ২০২৩, শুক্রবার, ১১:৩৭

ফ্লাইং রুশম্যানের জাহাজ তীরে ভিড়তে পারেনি

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

আমাদের অনেকে ফ্লাইং ডাচম্যানের কাহিনী কম বেশি জানে। এটি একটি ডাচ উপকাহিনী। একজন দক্ষ ডাচ নাবিক হেনর্ডিক ভ্যান ডের ডেকেন চাকরি হারিয়ে দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন। চাকরির সন্ধানে ঘুরছিলেন এ ঘাটে ও ঘাটে। কিন্তু চাকরি তিনি পাচ্ছিলেন না। তখন এক জাহাজ মালিক, যে কার্যত একজন শয়তান (ভূত)। তাকে অদ্ভুত এক চাকরির অফার করলো। সে হবে জাহাজের নাবিক, জাহাজ সমুদ্রে যাত্রা করবে কিন্তু কোন বন্দরে নোঙ্গর করতে পারবে না। ডেকেন এই শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি এতটাই দক্ষ নাবিক ছিলেন যে, ভেবেছিলেন কোন শক্তি তার জাহাজ নোঙ্গর করতে বাধা দিতে পারবে না। জাহাজে মাল-সামান খাবার দাবার, পানি ও জ¦ালানি সবকিছু তোলা হলো। তার সঙ্গে চললেন আরো কিছু নাবিক। জাহাজ নিরুদ্দেশের উদ্দেশে যাত্রা করলো। ডেকেন জানতেন না, কোথায় রওনা হয়েছেন। এভাবে দিন যায় মাস যায় বছর যায়। তিনি বন্দরে আলো দেখতে পান এবং সেদিকে রওনা হন। তীরে নামতে হবে। কিন্তু তীরের কাছাকাছি গেলেই কোন এক অদৃশ্য শক্তির বাধায় তার জাহাজ আবার নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করে। তারপরে বহু রূপকাহিনী, কোথাও কোথাও আছে জাহাজের অন্য কর্মীরা তীরে নামার জন্য দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করেন। যারা ডেকেনকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে ডেকেন তাদের গুলী করে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। সেভাবে ঐ জাহাজে তিনি হয়ে পড়েন সম্পূর্ণ একা। বন্দরের খোঁজে ঘুরতে থাকেন। কিন্তু কোথাও ভিড়তে পারেন না। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে ডেকেন বন্দরের উদ্দেশে তার জাহাজ চালিয়েই যাচ্ছেন। অনেকেই মনে করেন, ফ্লাইং ডাচম্যানের জাহাজ এখনো সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই দাবি করেন, তারা ফ্লাইং ডাচম্যানের জাহাজ দেখেছেন। দেখেছেন দূর থেকে ফ্লাইং ডাচম্যানের জাহাজ তীরের দিকে আসছে কিন্তু হঠাৎই তা বিপরীত দিকে যাত্রা শুরু করে। যখনকার কাহিনী তখন ভিডিও করার ব্যবস্থা ছিলো না। এখনও যারা দাবি করেন যে, তারা ফ্লাইং ডাচম্যানের জাহাজ দেখেছেন তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করে। অধিকাংশই বিশ্বাস করে না। কিন্তু ফ্লাইং ডাচম্যান নেদ্যারল্যান্ডসবাসীদের এক কৌতূহলের কারণও বটে। এই বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভিতরদিয়ে ফ্লাইং ডাচম্যানের কাহিনী এখনও জীবিত আছে। এ কাহিনীর আর একটা ভার্সনও আছে। আর তাহলো নাবিক ডেকেন পরকীয়া সন্দেহে তার স্ত্রীকে হত্যা করেন। শাস্তি এড়াতে তিনি ভূতের জাহাজে উঠেছিলেন। শর্ত ছিলো যে, তিনি সাত বছর পর পর ডাঙ্গায় ভিড়তে পারবেন। এবং ছয় মাস ধরে সৎ স্ত্রী খুঁজতে পারবেন। তারপর তাকে ফের জাহাজে উঠতে হবে।

সম্প্রতি তেমনি একটি ঘটনা ঘটে গেলো বাংলাদেশে। রাশিয়ার জাহাজ স্পার্টা-৩ নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই জাহাজটির উপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অর্থাৎ এই জাহাজ কোন দেশের নদী বন্দরে ভিড়তে পারবে না। রাশিয়া জাহাজটি নির্মাণ করেছিলো ২০০০ সালে। এর ধারণ ক্ষমতা ৭২৬০ টন। গত ২০ ডিসেম্বর জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি এসে পৌঁছে যায়। নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এই জাহাজটির উপর নজরদারি বজায় রেখেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। মোংলা বন্দরে জাহাজটির নোঙ্গর করার কথা ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি আসতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জানায় যে, জাহাজটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে এবং তা বাংলাদেশের কোন বন্দরে ঢুকতে দিলে পরিণতি ভালো হবে না। ফলে নতুন করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ার আশঙ্কায় রাশিয়ার ঐ জাহাজকে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা। জাহাজটি যে নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ জ্ঞাত ছিলো কিনা জানি না। কিন্তু জাহাজের নতুন নামকরণ করা হয়েছে উরসা মেজর। কিন্তু এসব জাহাজে অন্য একটা সমস্যা থেকেই যায় সেটা হলো জাহাজের আইএমও নাম্বার যা পরিবর্তন করা যায় না। স্পার্টা-৩ এইএমও নাম্বার ছিলো ৯৫৩৮৮৯২। সুতরাং মার্কিন নজরদারি থেকে জাহাজটি কখনোই মুক্ত ছিলো না। রাশিয়া জাহাজের শুধু নামই পরিবর্তন করেনি এর রংও বদলে দিয়েছে। যাতে দূর থেকে দেখলে জাহাজটিকে আর স্পার্টা-৩ মনে না হয়।

এই অবস্থায় জাহাজটিকে গ্রহণ না করলে দুপক্ষের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে বলে হুমকি দেয় রাশিয়া। এই হুমকি পাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কোন অবস্থাতেই যে বাংলাদেশ জাহাজটিকে গ্রহণ করবে না সেকথা জানিয়ে দেয়া হয়। এতে রাশিয়া চরম বিরক্তি প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ পক্ষ জানতে চায় যে, নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা আইএমও ৯৫৩৮৮৯২ সনদধারী স্পার্টা-৩ জাহাজটি নাম ও রং বদল করার বিষয়টি কেন বাংলাদেশের কাছে গোপন করলো রাশিয়া। জাহাজটি গ্রহণ করলে সমূহ বিপদের যে ঝুঁকি রয়েছে সেটা জানা সত্ত্বেও কেন মস্কো জাহাজটিকে বাংলাদেশ অভিমুখে পাঠালো।

ইতিমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। গত ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান। সাজেদুল ইসলাম প্রায় ১২ বছর আগে ‘সরকারি বাহিনী’ কর্তৃক গুম হন। তাকে কেন্দ্র করে সাজেদুল ইসলামের বোন সানজিদা ইসলাম মায়ের ডাক নামে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। পিটার হাস ঐ বাসায় যাওয়ার দুই দিন আগে থেকেই পুলিশ গোটা এলাকা রেকি করে। তারপরও ‘সরকারি মদতে’ মায়ের কান্না নামক নবগঠিত একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সাজেদুল ইসলামের বাড়ির সামনে পিটার হাসের সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যে, পিটার হাসের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত দল তাকে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পরামর্শ দেন। তিনি যখন শাহীনবাগের ঐ বাসা ত্যাগ করছিলেন, তখন তার গাড়ির উপর হামলা চালানো হয় এবং তার জামা ধরে টানাটানি করা হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ পিটার হাস সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং তার নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টিকে উপহাস করেই ছেড়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আপনি যে, শাহীনবাগে যাবেন সেকথা ফাঁস হলো কী করে। তিনি বলতে চাইলেন যে, দূতাবাসেই কেউ একথা ফাঁস করে দেয়; ফলে মায়ের কান্নাওয়ালারা সেখানে ভিড় জমায়। যদিও সেখানে কোন মাকে দেখা যায় নি। কম বয়সি তরুণ তরুণিরাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাছাড়া মোমেন বলেন, আপনার গায়ে তো আর হাত দেয়নি। বিষয়টাকে এতোটা হালকাভাবে নেওয়ায় মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ জানায়। তারা বাংলাদেশে গুম খুন বন্ধে মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানায়।

এসময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় রাশিয়া। রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে বলেন যে, পিটার হাসের সাইদুল ইসলামের বাসায় যাওয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। একই বিবৃতি দেয় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাশিয়া হয়তো আশা করেছিলো যে, এভাবে পাশে দাঁড়ানোর ফলে বাংলাদেশ তাদের কথা রাখবে এবং স্পার্টা-৩ জাহাজটিকে মোংলা বন্দরে ভিড়তে দেবে এবং সেখানে তারা মাল খালাস করবে। যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রকাশিত বার্তায় বলা হয়েছিলো যে, জাহাজটিকে নোঙ্গর করতে দেয়া কিংবা এতে তেল বা খাবার সরবরাহ করা হলে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টাকে ভালোভাবে নেবে না। উল্লেখ্য, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে বিবৃতি, টুইট ও পাল্টা টুইট করে বাংলাদেশ প্রশ্নে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকা অবশ্য তাদের উভয়কে এসব কর্মে নিরুৎসাহিত করছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যেসব তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য করেছেন তাও অবশ্য কোন কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। এর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে জাতিসংঘে প্রথম যে প্রস্তাব উঠে তাতে সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ। বরং ঢাকা মস্কোর পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু এরপর অজ্ঞাত কারণেই পুনরায় যখন একই প্রশ্নে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয় তখন বাংলাদেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। আমরা বাহ্যিক কারণগুলো দেখতে পাই কিন্তু ঘটনাবলির অন্তর্নিহিত কারণ সবসময় দেখতে পাই না। আর সে কারণেই রাশিয়ান জাহাজ বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি। জাহাজটি এখন ভারতীয় কোন বন্দরে রয়েছে। সেখানেই মাল খালাস করে ঢাকায় নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এর পরিণতি কী হতে পারে তা নিয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়া উভয়ই দ্বিতীয়বার চিন্তা করছে।

যদি মার্কিন দৃষ্টি এড়িয়ে জাহাজটি বাংলাদেশের বন্দরে ঢুকে যেতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশ বড় ধরনের মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে যেতো। একথা জেনেও রাশিয়া বাংলাদেশকে অমন বিপদের মুখে কেন ঠেলে দিতে চাইছিলো সেটি পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া চীন এই তিন দেশের কঠিন চাপের মুখে আছে। রাশিয়া হয়তো ভেবেছিলো যেহেতু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে রয়েছেন সেহেতু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতাধিন জাহাজটিকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশ গ্রহণ করবে। এর আগেও রাশিয়া ২০১৪, ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার বিজয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। কিন্তু এই দুটি নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়া কঠোর সমালোচনামুখর। যদিও স্পার্টা-৩ জাহাজে করে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য মালামাল আনা হয়েছিলো। এখন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের উৎপাদন এক বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং এতে খরচ আরো বাড়বে।

ঘটনা এখানে শেষ হয়ে গেছে মনে করার কোন কারণ নেই। সরকারের অত্যধিক ভারত তোষণ নীতির কারণে চীনও এখন সরকারের উপর যথেষ্ট বিরক্ত। সেকথা তারা দুই একবার যে বলেনি এমন নয়। সেক্ষেত্রে এখন ত্রিমুখি চাপে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। আসলে শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিলে এর চাইতে ভালো ফল আশা করা যায় না।

https://dailysangram.com/post/512830