৪ জানুয়ারি ২০২৩, বুধবার, ১০:৫২

যুগপৎ আন্দোলন : আমীরে জামায়াতের গ্রেফতার প্রসঙ্গ

-ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

মানুষ যখন ক্ষমতার জন্যে আকুল আকাক্সক্ষী হয়, তখন তার আচরণে পচন ধরে।’ কথাটি বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সংবিধান প্রণেতা থমাস জেফারসন। চার্লস মন্টেস্কু বলেছেন- “তার চেয়ে বড় স্বৈরাচার আর নেই, যা আইনের ঢালের আড়ালে এবং ন্যায়বিচারের নামে চালানো হয়ে থাকে। অথচ মানুষের জন্মগত অধিকারের গ্যারান্টি (Birth Rights of Man) দেশের সর্বোচ্চ আইন ‘সংবিধানে’ খচিত। যা বর্ণ, গোত্র, এলাকা, ভাষা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। মানুষ কেবল মানুষ হওয়ার কারণে এ মর্যাদা। মৌলিক অধিকারের ধরন ও বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করতে গিয়ে বিচারপতি জ্যাকশন বলেন, “কোন ব্যক্তির জীবন, মালিকানার স্বাধীনতা, বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখনির স্বাধীনতা, ইবাদত-বন্দেগী ও সমাবেশের স্বাধীনতা সংরক্ষিত। কিন্তু ক্ষমতার লোভেই শাসকগোষ্ঠী মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে বিভিন্ন সময়ে।

গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, অপসংস্কৃতির সয়লাব ও নৈতিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। গুম, খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক ও চোরাচালান ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, লুটপাট, দলীয়করণ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অনৈক্য, মিথ্যাচার ও দমন পীড়ন ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও আজ সরকারি দলের দুর্বৃত্তদের লুটপাট, দখলদারিত্ব ও নির্যাতনের কারণে অনিরাপদ এবং অতিষ্ঠ।

দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মেধার অবমূল্যায়ন, বৈষম্য, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা জনজীবন নাভিশ্বাস করে তুলেছে। দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলয় ভেঙে পড়েছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা -বাণিজ্যের অঙ্গনগুলো সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এদেশ এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর পরিবর্তে পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভ্যান্স প্যাকার্ড এর মতে “পুলিশী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো নিরাপত্তা তদারকির ভীতি তৈরি করা। নাগরিকগণের ধারণা জন্মে যে, তাদেরকে সব সময় নজরে রাখা হচ্ছে এবং তাদের কথাবার্তায় আড়িপাতা হচ্ছে। তাদের চিঠিপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাদের বাড়িতেও যেকোনো সময়ে আগ্রাসন হতে পারে”।

যুগের অধিক চলা এই দুঃশাসনে দেশের ১৮ কোটি মানুষ এখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। বিরোধী দলগুলো এখন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। এই মুহূর্তে জনগণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে আপসহীন সংগ্রামে রত। কিন্তু আন্দোলন দমনের নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে মানবাধিকার। বিরোধী মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে এখানে হামলা-মামলা আর বন্দুকের গুলীর জোরে স্তব্ধ করে দিতে চায় সরকার। স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ ও জনগণকে শাসন করার চেষ্টা চলছে এখানে। খুন-গুম, জীবনের নিরাপত্তাহীনতার অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে প্রতিটি নাগরিককে।

রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এই জালিম সরকারের জুলুম-নির্যাতন, বঞ্চনা, অপমান আর লাঞ্ছনার শিকার। মানুষের ভোটাধিকার ছিনতাই, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, লুটপাটের ঘটনা বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে প্রতিটি নাগরিককে। জনবিচ্ছিন্ন এই সরকার এখন জনগণকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। জেফারসনের ভাষায় ‘যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন এটা স্বাধীনতা’ আর ‘জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায়, এটা নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন’ এবং জনগণের স্বাধীনতা, অধিকার ও জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন।

দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে সরকার বিভিন্ন অপকর্ম করতে বাধ্য করছে, ফলে নিষেধাজ্ঞার শিকার হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের বাহিনী, মর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে বহির্বিশ্বে ; কিন্তু সরকার সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না। স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, ধর্মের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের স্বাধীনতা, পারিবারিক জীবনের অধিকার, ফৌজদারি মামলায় সুবিচার পাওয়ার অধিকার, অমানবিক শাস্তি থেকে নিষ্কৃতির নিশ্চয়তা ইত্যাদিই মানবাধিকারের পর্যায়ভুক্ত। সারা বিশ্বে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে, যা দেশের জন্যে মর্যাদা হানিকর।

আসলে যেখানে আইনের শাসন নেই বললেই চলে, জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে কিছুই থাকে না। দুর্নীতি জীবনের অনুষঙ্গে পরিণত হয়। আমরা এখন এমন দেশেরই নাগরিক। জাতিসংঘের মানবাধিকার-সম্পর্কিত ঘোষণা (United Nations Declaration of Human Rights) এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে ইউরোপীয় কনভেনশন (European Convention for the Protection of Human Rights and Fundamental Freedoms) ইত্যাদি। মানবাধিকার রক্ষার জন্যে এ সম্পর্কিত ইউরোপীয় আদালত (European Court of Human Rights)-ও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই সমস্ত সংস্থার স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন শূন্যের কোঠায়। শাসকগোষ্ঠী যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আর সামাল দিতে পারে না, তখনই এই পথের আশ্রয় নেয়।
ফ্যাসিবাদের দুই প্রধান মহানায়ক ছিলেন ইতালির বেনিতো মুসোলিনি এবং জার্মানির এডলফ হিটলার। তারাও আন্দোলন দমনে ক্ষেত্রবিশেষে ফ্যাসিবাদের আশ্রয় নেয়। এ কাজে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বিশেষত রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে। পৃথিবীতে একনায়কত্বের (Dictatorship) শাসন সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। কারণ শাসক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ যখন শাসিতের মতামতের ধার না ধেরে একচ্ছত্রভাবে শাসনকাজ চালিয়ে যায় তখন অনায়াসে জন্ম হয় একনায়কত্বের।

বাংলাদেশের বিরোধীদলগুলো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে বরাবরই বলে আসছে, এখানে এখন গণতন্ত্রের লেবাসে এক ব্যক্তির শাসনই বিদ্যমান। একনায়কত্ব সর্বদাই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের একছত্র স্বার্থে প্রতিপক্ষের ওপর সার্বিক নিষ্পেষণ চালিয়ে দেয়। আর এর মধ্য দিয়ে যা গড়ে উঠে Authoritarianism বা Autocracy বা Despotism ই হলো স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরশাসনবাদ বা স্বেচ্ছাচারবাদ। স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের বিপরীত এবং প্রায়ই গণস্বার্থবিরোধী। (চলবে-)

https://dailysangram.com/post/512636