১৬ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৭:১২

চলাচলে বিধিনিষেধ

সমন্বয়হীন গণপরিবহণ সরকারি নির্দেশনায় বিভ্রান্তিতে যাত্রীরা

‘অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়নি’

গণপরিবহণ অর্থাৎ সড়ক, রেল এবং নৌপথে যাত্রী চলাচল কিভাবে পরিচালিত হবে-তা নিয়ে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত আসছে। বাসে অর্ধেক আসনে যাত্রী নেওয়ার ঘোষণা আসার পর সে নির্দেশনাও সংশোধন করা হয়। শনিবার থেকে ট্রেনে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহণ শুরু করেছে। আন্তঃনগর ট্রেনে এ নিয়ম মানা হলেও কমিউটার ট্রেন চলছে স্বাভাবিক নিয়মে আগেরমতো যাত্রী নিয়ে। অন্যদিকে নৌপথে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও শতভাগ আসনে যাত্রী পরিবহণে অনড় মালিকরা। মন্ত্রিপরিষদ থেকে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারির পর গণপরিবহণ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলো সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীর শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, ‘সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো নির্দেশনা আমাদের প্রতি ছিল না। রোববার এ বিষয়ে ফের বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেব।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আজ পর্যন্ত (শনিবার) রেলের বিষয়ে আগের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে চলার নির্দেশনা বহাল আছে। রোববারের বৈঠকের পর নতুন সিদ্ধান্ত হলে তা সবাইকে জানানো হবে।’

এদিকে সঠিক তথ্য না থাকায় কাজে বের হতে দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। কমলাপুর রেল স্টেশনের একজন যাত্রী আমিনুল ইসলাম অনলাইনে টিকিট না পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় যুগান্তরকে বলেন, ‘যার যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চালাচ্ছে। ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের।’ রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা এখলাছ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘কোথাও অর্ধেক কোথাও শতভাগ যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। এটা কোনো নিয়ম? তিনি বলেন, ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহণের কারণে অনেক মানুষ এখন দূরপাল্লার বাসে ভিড় করবে। এতে নির্ঘাত বাসে বেশি যাত্রী বহন করা হবে। তাহলে এটা কী করোনা সংক্রমণের জন্য সহায়ক হলো?’ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় গণপরিবহণের তিনটি সেক্টর থেকে তিন ধরনের সিদ্ধান্ত আসে। পর্যায়ক্রমে সেসব সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও হচ্ছে। এতে করে করোনা নিয়ন্ত্রণের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।’

বিধিনিষেধ জারির পর এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও বিধিনিষেধ প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের কাছেই সঠিক তথ্য নেই। শনিবার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনিরা ইয়াসমিন রাজধানীতে বাসে অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ না করায় জরিমানা করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘অর্ধেক যাত্রী নিয়েই বাস চালাতে হবে। এখন (শনিবার) পর্যন্ত সেই নিয়মই আছে।’

বুধবার বাসের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কোনো ভাড়া না বাড়িয়ে অর্ধেক আসনে যাত্রী নিয়ে বাস চলাচল করবে। কিন্তু পরদিনই তা পরিবর্তন করে বলা হয়, যত আসন তত যাত্রী পরিবহণ করা যাবে। এর ফলে বিভ্রান্তি ও জটিলতা দেখা দেয়, যা এখন পর্যন্ত সুরহা হয়নি।

এছাড়া ১০ জানুয়ারি সরকারের তরফ থেকে জারি করা ১১ দফা বিধিনিষেধের ৬ নম্বরে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, এখানে অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ করার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, ‘ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে।’ অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সড়ক, রেল ও নৌ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এদের কারও পক্ষ থেকেই এই বিষয়টি ঠিকমতো বুঝেননি বলে মনে হলো। কারণ অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ বাধ্যতামূলক করতে হলে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা বা অর্ধেক জনবল নিয়ে অফিস করানোর সরকারি আদেশ জারি করতে হবে। করোনার বর্তমান পরিস্থিতি এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি বলে সরকার মনে করছে। কিন্তু যে কোনো অবস্থায় পরিস্থিতির অবনতি হলে যেন ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাই মন্ত্রিপরিষদের আদেশে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, শুরুতেই সমন্বিতভাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সুস্পষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করতে হতো। কিন্তু সেটি না করায় এত বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

শনিবার অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ও ভাড়া না বাড়িয়ে যাত্রী পরিবহণ শুরু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে বুধবার সড়কপথেও ভাড়া না বাড়িয়ে অর্ধেক যাত্রী পরিবহণের সিদ্ধান্ত আসে। পরদিন বৃহস্পতিবারই সেই সিদ্ধান্ত বদলে যত আসন তত যাত্রী পরিবহণের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত আসে। অন্যদিকে নৌপথে কিভাবে যাত্রী পরিবহণ হবে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্তই আসেনি। পরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিকভাবেই লঞ্চ চালানোর কথা জানা গেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) দেলোয়ার হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যত আসন তত যাত্রী নীতিতে নৌযাত্রী পরিবহণ করা হবে।

ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ শনিবার যুগান্তরকে বলেছেন, প্রথমে অর্ধেক আসনে সড়কপথে যাত্রী পরিবহণের সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছিল। পরে দেখা গেছে সব প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহণ কার্যত সম্ভব নয়। এ কারণে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যত আসন, তত যাত্রী এ নিয়মে বাস পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত সব বাস মালিককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যাত্রী পরিবহণের জন্য বাস এবং লঞ্চের সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করা গেলেও রেলের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। কারণ বাস এবং লঞ্চে তাৎক্ষণিক টিকিট কাটা হয়। অন্যদিকে রেলে টিকিট ৫ দিন আগে অগ্রিম কাটার সুযোগ আছে। তাই শনিবারের জন্য অর্ধেক আসনের টিকিট বিক্রি শুরু হয় বুধবার। এ কারণে বাধ্য হয়েই রেলে শনিবার অর্ধেক আসনে যাত্রী পরিবহণ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। শিগগিরই এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যত আসন তত যাত্রী নীতিতে রেলও ফেরত যাবে বলে জানা গেছে। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের আগে থেকে টিকিট কাটা শুরু হয়ে যাওয়ায় শনিবার থেকে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে। অগ্রিম টিকিট কেটে ফেলা যাত্রীদের পালা শেষ হলে আবারও সিট অনুযায়ী যাত্রী পরিবহণ করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/509317