১৩ জানুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার, ৩:২৮

বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়তে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বান, বাধা কী?

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন : ॥ গত কিস্তির পর ॥
জাতীয়তাবাদ নিয়ে টানা হেচরার কোন বিষয়ই নয়। আমরা বংলা ভাষায় কথা বলি বলেই- বাঙালি, বাংলাদেশে জন্ম তাইতো আমরা বাংলাদেশী। কিন্তু ধর্মীয় বা সম্প্রদায়ের দিক দিয়ে যখন আমরা পরিচয় দিব তখন নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে আমরা হব মুসলিম জাতি, হিন্দু ভাইরা হিন্দু জাতি, খৃষ্টানরা খৃষ্টান জাতি, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ জাতি, ইহুদীরা ইহুদী জাতি। এইভাবে পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে আমরা কোন জাতি আল্লাহ তা কুরআনে নিজেই বলে দিয়েছেন।

তাই এ বিষয়ে মতভেদের কোন কারণই থাকতে পারে না। ইসলামে কোন সাম্প্রদায়িকতা নেই। তবে সকল ধর্মের মানুষ নিজস্ব ধর্মীয় বৈশিষ্ট অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়।

অত্র লেখায় এ সংক্ষিপ্তভাবে মুসলিম সরকারের যে বৈশিষ্ট সমূহ আছে তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং মদীনা চার্টায় একবার চোখ বুলাতে পারলেই আমাদের পথ উন্মুক্ত হতে পারে বলে বিশ্বাস করি। ১ যাদেরকে লক্ষ্য করে আমার এ আবেদন, তাঁরা যদি ভিন্ন চিন্তা না করে ঈমানের দাবির প্রেক্ষিতে ইহা বিবেচনায় রাখেন তাহলে আমরা সবাই আল্লাহর নিকট ভাল কিছু পাব ইনশাআল্লাহ।

সোনার বাংলা গড়তে হলে নীচের মুসলিম সরকারের বৈশিষ্টসমূহ জানা দরকার এবং সে অনুসারে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বে আমাদেরকে প্রথমে ইসলাম ও জাহিলিয়াত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। ইসলাম হল মানব জাতির জন্য ইহকালিন শান্তি ও পরকালনীন মুক্তির জন্য দেয়া আল্লাহ ও রাসূল (সা.) হেদায়াত। জাহিলিয়াত হল শয়তানি শক্তি এবং আল্লাহর ও রাসূলের (সা.) প্রতি অবিশ্বাসী মানব গোষ্টীর মতাদর্শ ও চিন্তা ভাবনা।

আমাদেরকে বিশ্বাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, আসমান ও জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে তার সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর হুকুম মেনে সব কিছু চলছে। একদিন কিয়ামতে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। পুনরুত্থানের পর হিসাব নিকাশ হবে অতঃপর কর্মফল অনুসারে জান্নাত অথবা জাহান্নামের ফয়সালা হবে। সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষকেই জিনদের সহ ফলাফল ভোগের ঘোষণা আছে। মানুষ আল্লাহর গোলাম ও আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়ায় আগমন করেছে। সেই গোলামী ও প্রতিনিধির বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতেই মানুষকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং সরকার গঠনের মাধ্যমেই একমাত্র আল্লাহর দেয়া বিধিবিধান কার্যকর করতে হবে। ইসলামে মুসলিম সরকার গঠনের জন্য যে সব বৈশিষ্ট ধারণ করতে হবে নিম্নে তা উল্লেখ করা হলে।

মুসলিম সরকারের বৈশিষ্টসমূহ :
(১) রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক হিসেবে আল্লাহকে মানতে হবে।
(২) সকল ক্ষেত্রে একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তায়ালা এ কথা সংবিধানে থাকবে।
(৩) সরকারের সকল জনশক্তি আল্লাহর প্রতিনিধি, এ কথায় বিশ্বাস আনতে হবে এবং এর মর্যদা মূল্যায়ণ করতে হবে।
(৪) আইনদাতা অর্থাৎ মালিক হলেন আল্লাহ। সরকারকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে রাসূল (সা.) এর পথ অনুসরণের মাধ্যমে।
(৫) আইনের একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে শারীয়াহ রাষ্ট্রের সকল বিধিবিধানের ভিত্তি হবে কুরআন সুন্নাহ। কুরআন সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না। সংবিধানের এমন কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে না, যা কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী। সরকারের মনগড়া হুকুম জারি করার কোনো অধিকার থাকবে না। সুরা নেছা- ৫৯, সুরা-হুজরাত-১।
(৬) প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইজমা, কিয়াস ও ইজতেহাদের দরওয়াজা খোলা থাকবে। তবে এমন কোন আইন তৈরি করা যাবে না যা ইসলামের স্প্রিটের বিরুদ্ধে যাবে। এ বিষয়ে অত্র বইএ ব্যাখ্যা আছে।
(৭) দেশের প্রধান ও সরকারের প্রধান নির্বাচিত হবেন নৈতিকতার বিচারে এবং জনগণের পরামর্শে তথা ভোটের মাধ্যমে।
(৮) সকল ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল নির্বাচিত ও নিয়োগ লাভ করবেন আল্লাহর দেয়া হেদায়াতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে। আল্লাহ বলেন, ইন্না আকরামাকুম ইনসাল্লাহে আতকাকুম।
অর্থ : তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। হুজরাত-১৩।
অর্থাৎ : তোমাদের মধ্যে বংশ, অর্থের জৌলুশ, প্রভাব প্রতিপত্তির বিচার না করে সততা, ন্যায় পরায়ণতা, বিশ্বস্ততা, আমানত রক্ষা, খোদানুগত, আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠ ও পরকালের জবাবদিহিতে ভীত, দুনিয়ার প্রাধান্য কম দিয়ে আখেরাতের জন্য গুরুত্বদানকারী যে কোন বংশ বা গোত্রের ব্যক্তিই কোন দায়িত্বের বিবেচিত হবে। দুর্নীতি গ্রন্থ, অসৎ চরিত্রের লোক কোন ক্রমেই কোন পদে স্থান পাবে না।
(৯) লর্ড কোক ব্রাকটোন (Lord cock Bracton), ব্রিটের একজন চিফ জাস্টিস (যিনি দিনের এক চতুর্থাংশ উপসনা কাটাতেন) রাজার একটি উক্তির জবাবে বলেন, রাজা কোন মানুষের অধীন নন, তবে তিনি আল্লাহ ও আইনের অধীন। উনি বলেন, আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে মূল্যবান ভিত্তি এটাই হওয়া উচিত”রাজা আল্লাহ ও আইনের উর্ধ্বে নয়। যদিও তিনি একজন খৃষ্টান প্রধান বিচারপতি, আমাদের ধর্ম অনুসারে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর এ বিষয়ে যে সব নির্দেশনা, তার সাথে এর মিল আছে। মুসলিম সরকারের ক্ষেত্রেও তাই, তারা মানুষের অধীন নয় কিন্তু আল্লাহর ও তাঁর দেয়া আইনের অধীন।
(১০) চাকরি ছাড়া যারাই সরকার পরিচালনায় প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবেন তাদেরকে নিজের উদ্যোগে কোন পদের জন্য কাংখিত হওয়া যাবে না। তবে কোন বিভাগ ও বিষয়ে দায়িত্ব প্রদান করা হলে তার আনুগত্য করতে বাধ্য থাকতে হবে, এতে মৃত্যুর সম্ভাবণা থাকলেও অমান্য করা যাবে না।
(১১) মুসলিম সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় অধিকার ও বেচে থাকার মৌলিক অধিকার সমূহ স্বাধীনভাবে ভোগ করবে।
(১২) অন্যান্য ধর্মের নাগরিকদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া ও দেশ শাসনে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনে অংশীদার থাকবে।
(১৩) সকল মারুফ (ভাল) কাজ চালু করতে হবে এবং মন্দ কাজ বন্ধ করতে হবে শরীয়তী আইন দিয়ে ।
(১৪) ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর সব কিছু নিষিদ্ধ করতে হবে।
(১৫) মুসলিম সরকার পরামর্শর ভিত্তিতে কাজ করবে, এটি আল্লাহ ও রাসূল (সা.) হতে প্রামাণিত। সুরা শুরা-৩৮।
(১৬) সাম্যতত্ব: সাম্যতত্ব ইসলামী শরীয়তের এমন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যা সূচনা কাল থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট ও অনস্বীকার্যরূপে এতে বিদ্যমান।
(১৭) এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, (আরবি)
অর্থ :হে মানবজাতি, আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে তোমাদের কে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সেই প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যদার অধিকারী। সুরা হুজরাত-১৩
রাসূল (সা.) বলেন,
ক) সমস্ত মানুষ চিরুনির দাতের মত সমান। কোন আরবের কোন অনারবের উপর বিশেষ কোন মর্যাদা নেই তাকওয়ার ভিত্তি ছাড়া।
খ) আল্লাহ তায়ালা ইসলামের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের অহংকার ও বাপ-দাদার গর্ব করাকে বিলীন করে দিয়েছেন। কারণ সমস্ত মানুষ আদম থেকে সৃষ্টি এবং আদম মাটির তৈরি। তাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক সম্মানিত যে অধিক খোদাভীরু। এ অনুসারে সমস্ত মানুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশ্বের গোটা মানব জাতির জন্যই ইহা প্রযোজ্য ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, বর্ণ, মনিব, চাকর, শাসক ও শাসিত সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের সাম্যতত্ব অপরিহার্য।
(১৮) প্রতিবেশী রাষ্ট্র সহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে মানবিক মূল্যবোধে সু-সম্পর্ক থাকবে। শত্রু নয় বন্ধু ভাবাপন্য থাকবে। তবে ধর্মীয় কারণে মুসলিম দেশ সমূহের সাথে বিশেষ সম্পর্ক থাকবে।
(১৯) কেউ যুদ্ধের সম্মুখীন করলে রাষ্ট্রে পক্ষ থেকে তার মোন বেলা করতে হবে এবং কোরআন সুন্নাহর দেয়া যুদ্ধনীতি অনুসরণ করতে হবে।
(২০) রাষ্ট্র, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরীকের অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্বশীল হবে,
২১। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলমান নাগরিকদের পরের হক আদায়ে ও পরকালীন কল্যাণে দিকে গুরুত্ব দিয়ে ইহকালীন জীবন তৈরি ও পরিচালনা করার যোগ্যতা লাভে উদ্বুদ্ধ করবে।
২২। যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি ও সামাজকি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ধনী-গরীবের ব্যবধান দূর করে ইনসাফ পূর্ণ জীবনযাত্রা পরিচালনার ব্যবস্থা থাকবে।
(২৩) মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে কোন নাগরিক বঞ্চিত থাকবে না। জান ও মালের নিরাপত্তা, ইজ্জতের নিরাপত্তা, ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষালাভের অধিকার, ইবাদত ও উপাসনার অধিকার সবাই ভোগ করবে। নাগরিক অধিকার বা সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
(২৪) আদালতে আইনের বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা যাবে না। নাগরিককে কোনো অপরাধের অভিযোগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও আদালাতের রায় ছাড়া কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদেরও আইনের মধ্যে থেকে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। তাদের নিজস্ব সমস্যার সমাধান তাদের ধর্মীয় বিধান ও প্রথা অনুযায়ী করার অধিকার থাকবে।
(২৫) মুসলিম রাষ্ট্রের ঐক্য হচ্ছে একজন নেতা তথা খলীফাহর নেতৃত্বে, যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
এবং ঈমানদার, সং এবং রাসূল (সা.) ও চার ঘণ্টফিরি আদর্শ ও নীতি মেনে চলার যোগ্য হবেন। নাফিয়া (র:) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি (খলীফার) আনুগত্য হতে হাত গুটিয়ে নিল, সে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে এমনভাবে উত্থিত হবে যে, তার পক্ষে কোন প্রমাণ থাকবে না এবং যে তার কাধে খলীফার বাইয়াত না থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল সে যেন জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। (মুসলিম)
(২৬) খলিফা হিসেবে একজন রাষ্ট্র প্রধানকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। কেন একজন পুরুষ হতে হবে সি বিষয়ে নিম্নে আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) বক্তব্য দেখুন।
(ক) আল্লাহ বলেন, (আরবী) অর্থঃ নারীদের জন্যও ঠিক তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন পুরুষদের অধিকার আছে তাদের উপর। সুরা বাকারা-২২৮
কিন্তু নারী ও পুরুষের সাম্যের এই সার্বজনীন তত্ত্বের পাশাপাশি নারীর বিরপীতে পুরুষকে একটি বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে।
(খ) আল্লাহ বলেন, (আরবী) অর্থঃ অবশ্য পুরুষদের তাদের উপর একটি মর্যাদা আছে- বাকারা ২২৮
এই বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বর স্পষ্ট বর্ণনা অন্য স্থানে আল্লাহ বলেছেন (আরবী)
(গ) অর্থ : পুরুষ নারীর তত্বাবধায়ক এ জন্য যে, আল্লাহ তাদের এক জনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, পুরুষ নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করে- সুরা নিসা ৩৪ (চলবে)

https://dailysangram.info/post/477330