গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। ভরসা বৈদ্যুতিক চুলায়। মঙ্গলবার গোপীবাগ এলাকার একটি বাসার চিত্র
১২ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:১৮

পড়ে আছে গ্যাসের চুলা বিকল্পে খরচ বাড়ছে

রাজধানীর গোপীবাগের বাসিন্দা মেহেরুন নেছা চাকরি করেন ব্যাংকে। তাই সাতসকালেই তার দিনের রান্নার কাজ শেষ করতে হয়। গত দু'মাস থেকে তার এই রুটিন পাল্টে গেছে। আগের দিন রাতেই পরের দিনের সব রান্না শেষ করতে হয়। এরপর ভোরে উঠে তাড়াতাড়ি রাতের রান্নাগুলো গরম করতে হয়। কারণ সকাল ৭টার পরই চুলা জ্বলে না। লাইনে গ্যাস সরবরাহ প্রায় নাই হয়ে যায়। এই গ্যাস আসে বিকেল ৩- ৪টার দিকে। কিছুক্ষণ থেকে ফের চলে যায়, আসে রাত ১০টার দিকে। যখন অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েন। শুধু মেহেরুনের বাসাতেই নয়, সম্প্রতি রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার বসতবাড়ির চিত্র এটি। বিকল্প হিসেবে যারা একটু সচ্ছল তারা সিলিন্ডার কিংবা বৈদ্যুতিক চুলার আশ্রয় নিলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের চুলা জ্বলে না। এতে অনেককেই অন্তত এক বেলা না খেয়ে বা চিড়ামুড়ি খেয়ে কাটাতে হয়।

আবাসিকের পাশাপাশি কলকারখানা, সিএনজি স্টেশন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব খাতেই ভয়াবহ গ্যাস সংকট চলছে। সিএনজি স্টেশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাস রেশনিং করেও পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না জ্বালানি বিভাগ। পেট্রোবাংলা বলছে, সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। আরও মাস খানেক এমন সংকট থাকতে পারে বলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্রে জানা গেছে।

পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। বছর খানেক আগেও ৩৩০ থেকে ৩৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিত পেট্রোবাংলা। সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে। কমেছে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানিও। তাই সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছে। রাজধানীর রামপুরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, হাতিরপুল, পুরান ঢাকা, শ্যাওড়া, যাত্রাবাড়ীসহ বেশিরভাগ এলাকাতেই অধিকাংশ সময় চুলা জ্বলছে না। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ শিল্পকারখানা দিনের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। শিল্পকারখানার মালিকরা বলছেন, লাইনে গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি) থাকার কথা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে তিন-চার পিএসআই। এতে কারখানা চালু রাখা সম্ভব হয় নয়। বেশিরভাগ সময়ই শ্রমিকরা অলস সময় কাটান। দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এমন অবস্থা। সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদনে না থাকায় তারা আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে পোশাক, টেক্সটাইল কারখানাগুলোর সংকট চরম আকার নিয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সমাধান মিলছে না। এ কারণে আদেশ বাতিলের আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, দ্রুত গ্যাস সংকটের সমাধান না হলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গ্যাস মিলছে না সিএনজি স্টেশনেরও। সিএনজি স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারহান নূর সমকালকে বলেন, লাইনে একদম প্রেসার নেই। ১৫ পিএসআইর জায়গায় ২-৩ পিএসআই চাপ মিলছে। তিনি আরও জানান, তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে, যার পাশেই দেশের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র তিতাস অবস্থিত। সোর্সের পাশে থেকেও শহরে গ্যাস মিলছে না, এটা কখনও হয়নি।

গ্যাস সংকটে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। গ্যাসভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। তবে ঘাটতির কারণে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিতে পারে। এই সরবরাহও এখন ৭০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে তাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৯০ কোটি ঘনফুট, বিপরীতে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি ঘনফুট। আরেক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।

বিকল্প ব্যবস্থা :এই তীব্র গ্যাস সংকটে কীভাবে জ্বলছে রাজধানীবাসী চুলা? ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাদের টাকা আছে বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। যখন লাইনে গ্যাস থাকে না তখন সিলিন্ডার দিয়ে ঠেকা সারেন। অনেকে আবার বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার করছেন। যাদের এই বিকল্প ব্যবস্থা করার উপায় নেই তাদের খাবারের রুটিন বদলে দু'বেলা হয়েছে। সবচেয়ে কষ্টে আছেন যারা পোশাক কারখানার মতো দীর্ঘ শিফটের চাকরি করেন। তারা গ্যাসের 'হাইড অ্যাড সিক' খেলায় রান্নার সুযোগই পান না। এমনকি নিম্নবিত্ত অনেকে লাকড়ি দিয়েও রান্না করে ক্ষুধা নিবারণ করছেন।

গ্যাস সংকটের কারণ :গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, গত জুন মাস থেকে এলএনজি আমদানি কম হচ্ছে। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনও কমেছে। যার প্রভাব পড়েছে গ্যাস সরবরাহে। জ্বালানি বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সরাসরি এলএনজি কেনা বন্ধ আছে, তাই সরবরাহ কমেছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত এলএনজিকে গ্যাসে পরিণত করার দুই টার্মিনালের একটি গত মাস থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। দুই টার্মিনালের দৈনিক সরবরাহ ক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট হলেও এখন মিলছে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের টার্মিনালটি চলতি মাসে চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে গেছে। এ কারণে সহসা গ্যাস সংকট সহনীয় পর্যায়ে আসছে না বলে জানিয়েছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির এক ব্যবস্থাপক।

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, সরকারের নানা উদ্যোগে কয়েক বছর আগে দেশের দৈনিক গ্যাস উৎপাদন বেড়ে ২৭০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছিল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অচলাবস্থার কারণে বর্তমানে তা কমে ২৩০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে। আবার অনুসন্ধানেও তেমন জোর নেই। এলএনজির ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। লোকসান ঠেকাতে সরকার আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ সমস্যার দ্রুত সমাধান নেই। তবে দেশে বিশেষ করে সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং একটি এফএসআরইউতে ত্রুটি থাকায় এলএনজি সরবরাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। দেশীয় অনেক গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। যেসব কূপের উৎপাদন কমেছে সেগুলো 'ওয়ার্কওভার' করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুটি কূপের উৎপাদন বেড়েছে। তিনি আশা করেন, দ্রুত চলমান পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

https://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-last-page/article/2201140626