১২ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:০০

ডলার সঙ্কটের চাপ বাড়ছে

৬ মাসে ব্যাংকে বিক্রি ২২ হাজার কোটি টাকা

বিদায়ী অর্থবছরে বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছিল ২৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার, বিপরীতে বাজার থেকে কেনা হয়েছিল প্রায় ৭৯৪ কোটি উদ্বৃত্ত ডলার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। গত ছয় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে ২৫২ কোটি মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসাবে)। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। সামনে এ অবস্থার কোনো উন্নতি না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রির ধারা অব্যাহত রাখা হবে। আর এর প্রভাব সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রথমবারের মতো অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স-প্রবাহ প্রায় ২১ শতাংশ কমে যায়। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ২৯৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, যা চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে নেমেছে এক হাজার ২৩ কোটি ২৯ লাখ। রেমিট্যান্স-প্রবাহের এ বড় ধাক্কায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজার আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ডলারের মান বেড়ে গেছে, কমেছে টাকার মান। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স কমার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যেমন, অর্থবছরের প্রথম মাসে জুলাইতে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স কম এসেছিল প্রায় ২৮ শতাংশ। পরের মাসে আগস্টে তা কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে কম এসেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে কমেছে ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। একই ধারায় নভেম্বরে ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে কম এসেছে ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সুবাদে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ।

বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এমনিতেই ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। সেই সাথে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়। এতে ব্যাংকগুলোয় ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দামও। বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মজুদ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। তারা আশঙ্কা করছেন, ব্যয়ের দিক থেকে সাবধানতা অবলম্বন না করলে আর রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর আরো চাপ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত প্রায় দুই বছর যাবত করোনার প্রাদুর্ভাব থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। গত অর্থবছরে ডলারের চাহিদা কম থাকায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। ডলারের মান ধরে রাখার জন্য বাজার দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে প্রায় ৭৯৪ কোটি মার্কিন ডলার কেনা হয়েছিল। বিপরীতে বিক্রি করা হয়েছিল ২৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।

চলতি বছরের শুরুতেই আগের অর্থবছরের অবস্থা বহাল ছিল। এ কারণে আগস্ট পর্যন্ত বাজারে ডলারের তেমন কোনো সঙ্কট ছিল না। কিন্তু আগস্টের পর থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় পণ্য আমদানি বেড়ে যায়। কিন্তু অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকে। একদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়, বিপরীতে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের টান পড়ে। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে থাকে। এ সুবাদে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে ২০৮ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। আর গত ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ দিনে বিক্রি করা হয়েছে আরও ৩ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। সবমিলে ৬ মাস ৮ দিনে বিক্রি করা হয়েছে ২৫২ কোটি মার্কিন ডলার। যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে, ডলারের সঙ্কটের কারণে কয়েক দফা আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বাড়িয়ে ও স্থানীয় মুদ্রার দাম অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল প্রতি ডলার বিক্রি করা হয়েছে ৮৬ টাকা করে। যদিও খোলা বাজারে ডলারের মূল্য ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সামনে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো কমতে পারে। আর এ কমার ধারা অব্যাহত থাকলে ডলারের মজুদে চাপ বেড়ে যাবে। এতে ডলারের মূল্য আরো বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলার সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/635969