১১ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৯:২২

ঢাকায় সমানতালে বাড়ছে বায়ুদূষণ

মুহাম্মদ নূরে আলম : রাজধানীতে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ ভাগ। গড়ে ২০২০ সালে বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী দূষণের মাত্রা ছিল ১৪৫। যা ২০২১ সালে এসে হয় ১৫৯ দশমিক ১। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। ক্যাপসের পরিচালক ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, এ সময় (মধ্যরাত) আন্তজেলা বাসগুলো শহরের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। নির্মাণ সামগ্রী ট্রাকে করে রাতের বেলায় পরিবহন করা হয়। দিনের বেলায় গাড়ির গতি কম থাকায় রাস্তার ধুলা কম ওড়ে। রাতে এটা বাড়ে। গত পাঁচ বছরে ঢাকার বাতাস আরও বেশি বিষাক্ত হয়েছে। বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ২০ ভাগ। দিনে দূষণের চেয়ে ঢাকার রাতের বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার মধ্যে আব্দুল্লাপুর, মিরপুর ও শাহবাগকে সবচেয়ে দূষিত এলাকার তালিকায় রাখা হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, একটু উদ্যোগ নিলে আর সচেতন হলেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। জরিপে বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বায়ুমান সূচকের (একিউআই) গড় মাত্রা ছিল ২৩৫ দশমিক ১। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়ায় ২৬১ দশমিক ৬। যা দুই বছরের হিসাবে ১১ দশমিক ৩ ভাগ বেশি। একইভাব ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ২২০ দশমিক ৫। ২০২১ সালে বেড়ে হয়েছে ২৩১ দশমিক ৪।

২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী নির্মল বায়ু দিবস পালিত হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে এটি পালিত হওয়া শুরু হয়েছে। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো পালন হচ্ছে দিবসটি। তবে ঢাকা শহরে নির্মল বাতাস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আইকিউএয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সূচকে দেখা যায়, বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ শহরের একটি ঢাকা। মাঝে মাঝেই বেইজিং ও দিল্লিকে ছাপিয়ে সূচকে সবার উপরে উঠে আসে ঢাকার নাম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের আশপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা, শহরের মধ্যে মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে ঢাকার আকাশে কখনও নির্মল বাতাসের দেখা মেলে না। ঢাকায় গত ১৬ বছরে মাত্র কয়েকদিনের জন্য নির্মল বাতাসের দেখা পাওয়া গিয়েছিল গত বছরের জুলাই মাসে। আর সেটি সম্ভব হয় লকডাউন ও ঈদের ছুটির কারণে। এক সময় ঢাকায় বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল ইটের ভাটা। প্রায় ৫৮ ভাগ বায়ু দূষণ ঘটত ইটের ভাটা থেকে। কিন্তু এখন ইটের ভাটার দূষণকে ছাড়িয়ে গেছে নির্মাণ এবং গাড়ির ধোঁয়া। সড়ক নির্মাণ ও মেগা প্রজেক্টের কারণে প্রায় ৩০ ভাগ বায়ু দূষণ হচ্ছে। ইটের ভাটা থেকে এখন ৩০ ভাগ, যানবাহন থেকে ১৫ ভাগ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৯ ভাগ দূষণ হয়।

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২০ সালে ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের বায়ু দূষণের এই সমীক্ষা চালিয়েছে। এক বছরে রাজধানী ঢাকা শহরে বায়ু দূষণ ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে বলে একটি যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার আশেপাশের এলাকায় দূষণ সবচেয়ে বেশি বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও বনানীতে দূষণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। গবেষণায় বলা হয়, সামগ্রিকভাবে দেখা যায় যে ২০২০ সালে ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের গড় বস্তুকণা ২.৫ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৩৫.৪ মাইক্রোগ্রাম। ভূমি ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালে ৫টি এলাকার বস্তুকণা ২.৫ গড় মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৩৫.৪ মাইক্রোগ্রাম যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ১০.২ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালে বস্তুকণা ২.৫ গড় মান পাওয়া যায় প্রতি ঘনমিটারে ৩০৪.৩২ মাইক্রোগ্রাম। এ গবেষণার অংশ হিসেবে ঢাকা শহরের ১০টি সংবেদনশীল, ২০টি আবাসিক, ১৫টি বাণিজ্যিক, ২০টি মিশ্র এবং ৫টি শিল্প এলাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা হয়।

এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ন্যায় ২০২০ সালেও পুরানো ঢাকার আশেপাশের এলাকা যেমন লালবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, কামরাঙ্গীরচর ও সূত্রাপুরে দূষণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে রামপুরা ও তেজগাঁও শিল্প এলাকাও ২০১৯ সালের ন্যায় ২০২০ সালে অতিমাত্রার দূষিত ছিল। ২০২০ সালে আবাসিক এলাকাগুলো যেমন- ধানমণ্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও বনানীতে দূষণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে যেখানে ২০১৯ সালে দূষণের মাত্রা অনেকাংশে কম ছিল। ২০২০ সালে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কিছু এলাকা যেমন-মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় দূষণের পরিমাণ কিছুটা কম ছিল।

বাংলাদেশের জাতীয় আদর্শ বায়ু মান মাত্রা (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা ২.৫ বা পিএম ২.৫) প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে সর্বোচ্চ ৬৫ মাইক্রো গ্রাম নির্ধারণ করা হয়েছে। বস্তুকণা এর নিচে থাকলে ওই বায়ুকে নির্মল বায়ু হিসেবে ধরা হয়। সেই হিসেবে গত জুলাই মাসে নির্মল বায়ু পেয়েছে রাজধানীবাসী। কারণ, জুলাই মাসে ঢাকায় বায়ুতে পিএম ২.৫ ছিল ৩১.৩১ মাইক্রো গ্রাম। এ বছর মার্চে বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। ডাব্লিউএইচওর মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকলে তাকে সহনীয় বলা যেতে পারে। সেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া ও আফগানিস্তানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল ৭৭ থেকে ৪৭ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার গণমাধ্যমকে আরও বলেন, গত পাঁচ বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে থেকে যদি ধরি, তবে বায়ু দূষণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চের আগ পর্যন্ত দূষণ ক্রমাগত বাড়ছিল। মার্চের পর কোভিডকালীন এই মাত্রা কিছুটা কম ছিল। তিনি তাদের গবেষণার কথা তুলে ধরে বলেন, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঈদ ঘিরে মোট ৫০ দিন ঢাকায় বায়ুর মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫০ দিনের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৬ দিন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করে। ২০১৭ সালের ঈদুল ফিতরের পরের দুই দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪২ ও ৩৬ এবং ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের পরদিন বায়ুমান সূচক ছিল ৩৭; ২০১৯ সালে ঈদুল আযহার পরের দুই দিন বায়ুমান সূচক ছিল ৪৯ ও ২২; আর ২০২১ সালে ঈদুল আযহার এক দিন পর বায়ুমান সূচক ৪৪ ছিল।

এই অধ্যাপক বলেন, ২০২১ সালে এসে আবার বায়ু দূষণ বাড়তে থাকে। সাধারণত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি এই চার মাস প্রায় ৭০ ভাগ বায়ু দূষণ হয়ে থাকে। আর জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এই চার মাসে মাত্র ১০ ভাগ বায়ু দূষণ হয়। শুষ্ক মৌসুমে যে দূষণ হয়ে থাকে, সেটা যদি আমরা কমিয়ে আনতে পারি, তবে একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ু দূষণ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, দূষণ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বায়ুর মানের মাত্রা যেমন থাকা উচিত, সেখানে শীতকালে ১০ থেকে ২০ ভাগ দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। বর্ষার সময় কিছুদিন মাত্রার মধ্যে দূষণ থাকলেও বাকিটা সময় দূষিত থাকে। অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া আসে। আমাদের আশপাশের কারখানা, নির্মাণকাজ আর যেসব ময়লা আগুনে পোড়ানো হয়, সেখান থেকেও ধোঁয়া আসে।

বাপার নির্বাহী সহ-সভাপতি আব্দুল মতিন গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত চারটি কারণে বায়ু দূষণ বাড়ছে প্রথমত, উন্নয়ন কাজ। দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগত নির্মাণকাজ। তিন নম্বরে আছে ইটভাটা ও চার নম্বরে শহর পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলো ওড়ানো। তিনি আরও বলেন, করোনার পর সরকারি উন্নয়ন কাজগুলো দ্রুতগতিতে চলছে। আমরা উন্নয়নবিরোধী নই। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে যাতে দূষণ না ঘটে সে ব্যবস্থা যদি উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নিতে পারে আমরা কেন পারবো না। ব্যক্তিগত কনস্ট্রাকশন কাজগুলো করার ক্ষেত্রেও দরকার সচেতনতা।

আব্দুল মতিন বলেন, এ ছাড়া ইটভাটাগুলোতে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। কয়লায় এত সালফার থাকে যে, তা বাতাসে মিশে বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে ব্যাপক হারে। এদিকে রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেয়া, দোকানপাট পরিষ্কারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলেও ধুলার সমাধান করা সম্ভব।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক আশা করে গণমাধ্যমকে বলেন, ২০২৩ সালের পর বায়ু দূষণের মাত্রা কমে আসবে। এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দূষণের যে উৎস রয়েছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের প্রধান কাজ। আর প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা। সরকার থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে, পোড়ানো ইট দিয়ে আর কোনো সরকারি নির্মাণকাজ হবে না। ২০১৯-এর অক্টোবরে এটি হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ২০২৫-এর মধ্যে রাস্তা ছাড়া সব নির্মাণ কাছে হবে পরিবেশবান্ধব ব্লক দিয়ে।

তিনি বলেন, ইট থেকে সরে আসার চেষ্টা হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আমরা ইট ভাটার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। দেশে ৮ হাজার ইটভাটা আছে। এখন সেটা কমে আসবে। আমরা আশা করছি, ২০৩০ সালের সনাতন পদ্ধতির ইট ভাটা ২০ ভাগে নিয়ে আসতে পারব। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২১ তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে জিয়াউল হক বলেন, এটা মন্ত্রণালয়ে ভেটিং পর্যায়ে আছে। আগামী মাসের মধ্যেই এটা পেয়ে যাব, সেখানে অনেক কিছুই সংযুক্ত করা হবে। তবে আশা করছি, ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ ও মেগা প্রজেক্টের কাজ যেহেতু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে, তাই ২০২৩ সালে বায়ু দূষণ কমার ক্ষেত্রে উন্নতি দেখতে পাব।

https://dailysangram.info/post/477106