১১ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৯:১৩

বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়তে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বান, বাধা কী?

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন : ॥ গত কিস্তির পর ॥
১। হাদীস : ইরবাজ ইবনে সারিয়াহ (রা:) বলেছেন, একদিন রাসূল (সা.) আমাদের নিকট হৃদয়স্পর্শী উপদেশ (নছিহত) প্রদান করলেন, যাতে আমাদের চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে এলো এবং অন্তরসমূহ ভয়ে প্রকম্পিত হলো, তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) নিশ্চয়ই আপনার এই উপদেশ বিদায়ী ভাষণ। এখন আপনি সুনির্দিষ্টভাবে কি নির্দেশ দিচ্ছেন?

রাসূল (সা.) বল্লেন, আমি তোমাদের সুস্পষ্ট দীনের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত, তার দিনের মতই উজ্জ্বল। আমার পরে যে ব্যক্তি এর থেকে বিমুখ হবে, সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তোমাদের মাঝে যে তখন বেঁচে থাকবে, সে অবশ্যই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। অতএব, তোমাদের ওপর আমার সুন্নত এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের অনুসরণ করা কর্তব্য। তোমরা তা দাঁত দিয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে। অবশ্যই আনুগত্য করবে যদি নেতা হাবশী গোলামও হয়। ইবনে মাজাহ-৪৩

কোন আদলে সোনার বাংলা? মদীনার, না উন্নত অমুসলিম রাষ্ট্রের আদলে?
উপরে উল্লেখিত পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ, আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থা সামনে রেখে বিশেষ করে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার পরিচয় বিবেচনায় নিয়ে কেমন সোনার বাংলা গঠন করতে চাই প্রথমেই তার সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। সোনার মদীনার আলোকে না পৃথিবীর উল্লেখিত দেশগুলোর আলোকে? উল্লেখিত দেশ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং সে আলোকে অথবা নিজস্ব পরিকল্পনায় জাতীয় পরিচয়ে কি অবস্থা হতে পারে সে বিষয়েও কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে।

সোনার মদীনার আলোকে সোনার বাংলা গড়লে তার সুফল কি?
(১) এ ধরনের রাষ্ট্র গঠন করতে আল্লাহর নির্দেশ আছে এবং তা পালন করে তার দেয়া পুরস্কার লাভ করা যাবে ঐদিন যেদিন কেউ কারও উপকারে আসবে না।
(২) মৃত ব্যক্তির আশা পূরণ হবে এবং যারা প্রচেষ্টা চালাবেন তাদেরসহ মৃত্যুর পর সকলেই সাদকা জারিয়ার সোয়াব পেতে থাকবেন। হাদীসে ভাল কাজের সূচনাকারী মৃত্যুর পরও তার ঐ প্রচেষ্টার জন্য সুফল পেতে থাকবে। হাদীস : যে ব্যক্তি কল্যাণের পথ দেখায় তার সমপরিমাণ সোয়াব সে পাবে। (মুসলিম, আবু দাউদ)।
(৩) হাদীসে উল্লেখ আছে, হাশরের মাঠে সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া পাবেন। তার মধ্যে এক শ্রেণী হবেন ন্যায়পরায়ণ বাদশা (শাসক) যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারাই সহযোগী থাকবেন তারাও আল্লাহর নিকট থেকে পুরস্কার পেতে বঞ্চিত হবেন না।
(৪) আমলে সালেহ (সৎ আমলের) শ্রেণীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেসব আমলে সালেহ রয়েছে সেগুলোর হক আদায় করে সম্পৃক্ত সকলেই আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির আশা করতে পারবেন। নিচে রাষ্ট্র পর্যায়ে আমলে সালেহ (সৎ আমলের) সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হলো।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সৎ আমলগুলো (আমলে সালেহ) কি কি? যেগুলো সরকারের বড় ইবাদত।
(ক) সুশাসন পরিচালনা করা। ন্যায়পরায়ণ শাসকের আনুগত্য করা।
(খ) ন্যায়বিচার করা।
(গ) জনগণের আমানত রক্ষা করা ও পাহারা দেয়া।
(ঘ) রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা।
(ঙ) সালাত কায়েম করা এবং যাকাত ব্যবস্থা চালু করা।
(চ) আমর বিল মা’রুফ (ভাল কাজের আদেশ ও প্রচার প্রসার) এর কাজ করা।
(ছ) নাহি আনিল মুনকার (মন্দ ও দুষ্কৃতি প্রতিরোধ করা) এর কাজ করা।
(জ) জনগণের পারস্পরিক বিরোধ মীমাংসা করা, বিচার ফায়সালা করা।
(ঝ) জাতীয় সংস্কার সংশোধনের কাজ করা। শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
(ঞ) জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজ করা (ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা)।
(ট) রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষায় সৈনিকের দায়িত্ব পালন করা।
(ঠ) চুক্তি ও সমঝোতা করা।
(ড) চুক্তি ও অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা।
(ঢ) ইসলামী আইন ও দণ্ড কার্যকর করা।
(ণ) নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।
(ত) অশ্লীলতার প্রসার রোধ করা।
(থ) যার কোন অভিভাবক নেই তার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা। (সূত্র হাদীস বিশেষজ্ঞ) ইবনে হাজার আসকালানি।
আমলে সালেহকারীদের জন্য আল কুরআনে ঘোষিত পুরস্কার-

(১) আল্লাহ বলেন : (আরবী) অর্থাৎ- “ঈমান এনে যে কোন পুরুষ বা নারী আমলে সালেহ করবে- আমি তাকে দান করব উত্তম পবিত্র জীবন এবং তাদের পুরস্কার দেবো তাদের সবচেয়ে ভাল কাজগুলোর ভিত্তিতে।” (সূরা নাহল : ৯৭)।

(২) “তবে যে কেউ ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ করবে, তার জন্য থাকবে সর্বোত্তম পুরস্কার এবং তার প্রতি আমার বিষয়গুলো বলবো সহজভাবে।” (সূরা আল আহকাফ)

(৩) “যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, তারা সৃষ্টির সেরা। তাদের পুরস্কার রয়েছে তাদের রবের কাছে। চিরস্থায়ী জান্নাত যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।” (সূরা বাইয়্যেনা, ৭-৮)

(৪) সূরা নূর-এর ৫৫ আয়াত : তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও আমলে সালেহ করে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদেরকে তেমনিভাবে যমিনে খেলাফত (রাষ্ট্রক্ষমতা) দান করবেন যেমনভাবে খেলাফত দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তী লোকদের। তিনি প্রতিষ্ঠিত করে চাইবেন তাদের মনোনীত পছন্দের দীনকে। তাদের ভয়ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশকে বদল করে তাদের প্রদান করবেন নিরাপত্তার পরিবেশ। এ বিষয়ে আরও অনেক আয়াত আছে।

সোনার দেশ গড়তে আল্লাহর নির্দেশ
(১) আল্লাহ বলেন (আরবী) অর্থাৎ- “আর দোয়া করো যে, হে পরোয়ারদেগার! আমাকে যেখানেই লয়ে যাও সততা সহকারে লয়ে যাও আর যেখান হতেই তুমি আমাকে বের করো সততার সাথে বের করো এবং তোমার নিকট থেকে একটি সার্বভৌম শক্তি আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও। অর্থাৎ আমাকে একটি রাষ্ট্র শক্তির অধিকারী বানাও অথবা রাষ্ট্রশক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানাও। (সূরা বনী ইসরাইল, ৮০)।

মক্কী জীবনের ১৩ বছরে রাসূল (সা.) যখন যোগ্য ও সালেহ একদল সাহাবী (রা.) তৈরি করতে পারলেন এবং একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো, তখনই আল্লাহ রাসূল (সা.)কে সোনার দেশ গঠন করার জন্য ঐ নির্দেশ দিলেন।

এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) একটি হাদীসে বলেন, “ইন্নাল্লাহা লা-ইয়াযায়ুবে সুলতানে মা-লা ইয়া যায়ুবিল কুরআনে।” অর্থ : আল্লাহ রাষ্ট্র শক্তির দ্বারা ঐসব বন্ধ করেন যা কুরআনের দ্বারা সম্ভব নয়।

মুসলিম সরকার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আল্লাজিনা ইমমাকান্না হুম ফিল আরজে আকামুস সালাতা ওয়া আতায়ুয যাকাতা ওয়া আমরুবিল মারুফি ওয়া নাহাও আনিল মুনকার ওয়া লিল্লাহে আকিবাতুল ওমুর।” (সূরা হজ্ব : ৪১)
যদি পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দান করি তাহলে এরা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহর হাতে।
আইন বিধান করতে আল্লাহর নির্দেশ

(২) আল্লাহ বলেন, (আরবী) অর্থ: “হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের চেয়ে অগ্রগামী হয়ো না। আল্লাহকে ভয় করো আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন।” (সূরা হুজরাত-১)
অর্থাৎ- আল্লাহ ও রাসূলের দেয়া বিধি বিধান ও আইন কানুনকে পাস কেটে নিজেদের মনগড়া আইনের আনুগত্য করো না।
আল্লাহ বলেন, (আরবী) অর্থ : হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের। আর সেইসব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। (সূরা নেসা : ৫৯)। এ আয়াতটি ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বুনিয়াদ। মুসলিম সরকারের শাসনতন্ত্রের প্রথম নম্বর ধারা। আল্লাহকে মেনে নেয়ার পর রাসূল (সা.)কে মেনে নেওয়ার পর তাদের সব কথাই ঈমানদারদের মানা ফরজ। রাসূলের শিখানো নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত করা যেমন ফরজ; তার শেখানো রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দেশ পরিচালনা করাও ফরজ।

খোলাফায়ে রাশেদীনরা তার পথ ধরেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। আল্লাহর দেয়া বিধিবিধানের চেয়ে যদি মানুষের তৈরি বিধিবিধান গ্রহণ করা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে আল্লাহকে দুর্বল মনে করা হয় (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহর চাইতে মানুষের জ্ঞান ও যোগ্যতা কি বেশি হতে পারে (নাউযুবিল্লাহ)? তাহলে আল্লাহর হেদায়েত বাদ দিয়ে মানুষের মতবাদ কেমন করে গ্রহণ করা যায়?

কুরআন সুন্নায় প্রত্যক্ষভাবে কোন আইন বিধান না পেলে সেখানে ইজমা কিয়াস করে আইন তৈরির সুযোগ আছে যদিও তা কুরআন-সুন্নাহর স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।

মানুষ আল্লাহর ইখতিয়ার ও অধিকারে হাত দিলে তা শিরক হয়ে যায়, যা সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ এবং ক্ষমার যোগ্য নয়। (সূরা নেছা, ৪৮)।
এ ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেন, (আরবী) অর্থ: শীঘ্রই সেই সময় এসে যাবে যখন আমি সত্য অস্বীকারকারীদের মনের মধ্যে বিভীষিকা সৃষ্টি করে দেব। কারণ তারা আল্লাহর সাথে তার খোদায়ী কর্তৃত্বে অংশীদার করে যার সপক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণপত্র অবতীর্ণ করেননি। (সূরা ইমরান-১৫১)। অর্থাৎ- আল্লাহর নাজিলকৃত আয়াত গ্রহণ করে কোন বিষয়ে ফয়সালা না করলে তিনি তা অস্বীকার করার কথা বলেছেন এবং তার খোদায়ী কাজে কর্তৃত্ব অর্থাৎ শিরক করা বুঝিয়েছেন।

মহামান্য রাষ্ট্রপতির জাতীয় আহ্বান ও প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত সেনার বাংলা গড়ার একমাত্র পন্থা-
যেহেতু দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান, সবাই আল্লাহ ও রাসূল (সা.)কে মানেন, কুরআনকে পূর্ণভাবে গ্রহণ করে যদি নবী করীম (সা.)-এর দেখানো পথে দেশকে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাহলে কোন মুসলমানই কুরআনের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। এজন্য যে কোন দলের নামে হোক অথবা বিভিন্ন দলের কমন লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে নির্দিষ্ট গোলে পৌঁছার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের সংবিধানের আলোকে মুসলিম সরকারের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া যাবে।

ধারা-৮ (১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই নীতি সমূহ এবং তৎসহ এই নীতি সমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগনিত হইবে।

(২) এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যা দানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তা রাষ্ট্র ও নাগরিকের কার্যের ভিত্তি হইবে।
* সংবিধানের প্রস্তাবনায় : চারটি মূলনীতি ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :

অনুচ্ছেদ ২-এ উল্লেখ আছে
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে মূলনীতি হইবে।

অনুচ্ছেদ ৩-এ ব্যাখ্যা : আমরা আরোও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। (চলবে)

https://dailysangram.info/post/477142