১১ জানুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ৯:১০

বৃহত্তম মুসলিম দেশ নিয়ে কিছু কথা

ড. মো. নূরুল আমিন : ব্যাংক রাকায়াত ইন্দোনেশিয়ার আমন্ত্রণে ১৯৯৮ সালে আমার পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া সফর করার সুযোগ হয়েছিল। ব্যাংক রাকায়াত ঐ দেশটির বৃহত্তম ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা। এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক থেকেও প্রাচীন এবং সেই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে এর অবদান অপরিসীম। তিন সপ্তাহ সফরে আমরা ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা, যোগ জাকার্তা, ডেন পাসার প্রভৃতি বড় বড় এলাকা সফর করেছি এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি।

আমার সফর সঙ্গীদের মধ্যে প্রত্যেকেরই একটা অতিরিক্ত কৌতূহল ছিল বৃহত্তম এই মুসলিম দেশটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এর বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য দেখে আমরা হতবাক হয়েছিলাম।

ব্যাংক রাকায়াতের ওভারসিজ বিভাগের প্রধান সীতা সুন্দরী বিমান বন্দরে আমাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রথমে তার দফতরে ও পরে হোটেল নভোটলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বৃহত্তম মুসলিম দেশের বৃহত্তম ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের প্রধান হিসেবে সীতা সুন্দরী নামে অমুসলিম একজন মহিলাকে দেখে আমরা অবাক হয়েছিলাম। হোটেলে পৌঁছার পরই জোহরের নামাযের সময় হলো। সীতা সুন্দরী আমাদের নামায পড়ার জন্য নির্ধারিত স্থান দেখিয়ে দিয়ে বললেন যে, তিনিও নামাজ পড়বেন এবং নামাযের পর একত্রে লাঞ্চ করবেন। পরে জানলাম সীতা সুন্দরী মুসলমান, তার মতো সব মুসলমান কর্মজীবী মহিলারাই স্কাট পরেন এবং প্রত্যেকের দফতরে বা সাথে নামাযের জন্য আলাদা পোশাক থাকে। নামাজের সময় হলে স্কাট বদলিয়ে লম্বা পোশাক ও হিজাব পরে নামায পড়েন।

বলাবাহুল্য ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের প্রসার ঘটেছিল আরবীয় বণিকদের দ্বারা। তাদের সাথে কিছু কিছু ফকির-দরবেশও সেই দেশে আগমন ঘটেছিল। তবে কোন বহিরাগত মুসলমান শাসকের আগমন সেই থেকে ঘটেনি। ওলন্দাজ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত স্থানীয় মুসলমানরাই ইন্দোনেশিয়া শাসন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীরা ওলন্দাজদের তাড়িয়ে ইন্দোনেশিয়া দখল করে নেয়। জাপানীরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশটি ত্যাগ করার পর ডা. আহমদ শোয়েকার্নোর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ওলন্দাজরা দেশটি পুনরায় দখলের জন্য সৈন্য বোঝাই জাহাজ পাঠিয়েছিল কিন্তু ঐ জাহাজকে ভারত মহাসাগরে যেতে দেয়া হয়নি। ইন্দোনেশিয়াও স্বাধীনতা হারায়নি।

ডা. শোয়েকার্নোকে ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা বলা হয়। তিনি সেক্যুলার ভাবাপন্ন লোক ছিলেন। সেই দেশে গিয়ে তাদের জাতির পিতা সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। বিষয়টি সীতা সুন্দরীকে জানালাম। তিনি ডা. শোয়েকার্নোর নিজের লেখা আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদের একটি কপি সংগ্রহ করেছিলেন। আত্মজীবনীটি পড়ে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। শোয়েকার্নো অত্যন্ত সাদাসিধাভাবে তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী। মদ এবং নারীর প্রতি তার অতিরিক্ত আসক্তি রয়েছে। তার পুস্তকে উল্লেখিত অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে আমি মাত্র দু’টি ঘটনা উল্লেখ করলাম।

তিনি বলেছেন, তার এক স্ত্রীর আগের তরফের এক কন্যা ছিল। কন্যাটি তার গৃহেই বড় হয়েছিল। একদিন বাড়ির পেছনের বাগানে বেড়াতে গিয়ে মেয়েটি তার চোখে পড়েছিল। তাকে তার খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। তিনি তাকে কাছে ডাকলেন এবং নষ্ট করলেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি তার জাপানী পত্নী রত্মাকে নিয়ে। তিনি পণ্যের জন্য ন্যুড ছবি তুলতেন। একবার পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইন্দোনেশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। তিনি এক ভোজসভায় রত্না দেবীর সাথে বল ড্যান্স করতে করতে পার্শ্বের একটি কামরায় ঢুকে পড়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। শোয়েকার্নো লিখেছেন, ভুট্টো মনে করেছিলেন আমি এ দৃশ্য দেখিনি। কারণ তিনি রত্নাকে জড়িয়ে ধরে নাচছিলেন এবং আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তারপর যখন মনে করলেন আমার দৃষ্টি তাদের দিকে নেই তখন হুট করে পাশের কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, যে দেশের জাতির পিতার চরিত্রের এমন নমুনা সে জাতির চরিত্র কেমন হতে পারে? জুলফিকার আলী ভুট্টো পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পাকিস্তান হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ, সে সময়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে ইসলামিক রিপাবলিক কথাটাও যুক্ত ছিল। এর সাথে এ কথাটা যুক্ত করা সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের একদা সামরিক শাসক ও প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদের নারী প্রীতি নিয়ে অনেক ঘটনা ও গল্প এখনও প্রচলিত আছে। এই দেশের সুন্দরী মেয়েরা এখনও তার জন্য কাঁদে।

সফরকালে আমার মনে হয়েছে সাধারণ মুসলমানরা অত্যন্ত সহজ সরল। তারা ধর্মভীরু, নামায পড়েন, রোযা রাখেন। মেয়েরা স্কাট পরে, ছেলেরা লুঙ্গি পরে। অফিস ও ব্যবসা কেন্দ্রে অনেক মহিলা কুরআনের হাফেজা দেখতে পাওয়া যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম ও অমুসলিম মেয়েদের সহজেই চেনা যায়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন শপিং সেন্টারেও একই অবস্থা। সেখানে মাথায় স্কার্ফ ছাড়া কোন মুসলমান মেয়ে দেখা যায় না। মসজিদসমূহে ওয়াক্তিয়া নামায পড়তে যান, সেখানে প্রত্যেক মসজিদেই মেয়েদের জন্য নামায পড়ার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রয়েছে। অভিজাত মুসলিম পরিবারে একটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের হজ্ব করিয়ে আনা হয়। শাসকরা ইসলামকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে আলাদা করে রেখেছে। তথাপিও একাধিক ইসলামী আন্দোলন সে দেশে সক্রিয়। তারা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে মানে এবং সমাজে তা প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয়। আগেই বলেছি ইন্দোনেশিয়া ও তার পার্শ্ববর্তী সমুদ্র তীরবর্তী দেশ ও দ্বীপাঞ্চলগুলো আরব ব্যবসায়ীদের প্রভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।

এভাবে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, ফিলিপাইন, ভারতের কেরালা, বোম্বে প্রভৃতি অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভারতে মুসলমান রাজত্ব কায়েম হলে ইসলামী রাষ্ট্রীয় ও সমাজব্যবস্থার কিছুটা স্বাদ ভারতীয় মুসলমানরা পাওয়ার সুযোগ পেলেও দূরপ্রাচ্যের মুসলমানরা তা কখনো পায়নি। ইসলামকে তারা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে আদি থেকেই রেখে দিয়েছে। এর ব্যতিক্রম শুধু মালয়েশিয়া। এই দেশটি পুরোপুরি ইসলামী না হলেও ইসলামী জীবনব্যবস্থার উপর তারা নানা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে ইসলামী আন্দোলন পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাইরে সক্রিয়। তিনটি রাজ্যে এককভাবে ইসলামিক পার্টি সরকার গঠন করেছে। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে সেই দেশের সরকার এবং জনগণ নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিতে গর্বানুভব করে।

পক্ষান্তরে ইন্দোনেশিয়ায় সরকারের আদর্শিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে বহু লোককে খৃস্টান হয়ে যেতে দেখা গেছে। নব্বইয়ের দশকে সে দেশে প্রায় দুই লাখ লোককে খৃস্টান হয়ে যেতে দেখা গেছে। মিশনারীদের তৎপরতা ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এর জন্য প্রধানত দায়ী। পূর্ব তিমুরের মুসলমানরা একচেটিয়া খৃস্টান হয়ে গিয়েছিল এবং পরে তারা ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা হয়ে সাম্রাজ্যবাদী খৃস্টান রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করেছিল। ইন্দোনেশিয়ায় বহু পরিবার আছে যেখানে মা-বাবা মুসলমান; সন্তানরা খৃস্টান। তারা একই ছাদের নিচে আছে। নাম দেখলে বুঝা মুশকিল তারা আসলে কি? ইসলামী অনুশাসন না মানলে বৃহত্তম মুসলিম দেশ তা প্রথম হোক, দ্বিতীয় বা তৃতীয়; কিছুতেই গর্বের বস্তু হতে পারে না।

১৯৬৮ সাল থেকে ৪/৫ বছর ইন্দোনেশিয়ায় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল এবং এতে প্রায় দেড় কোটি লোক নিহত হয়েছিল। কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে ছিল এই যুদ্ধ। যুদ্ধে তারা কম্যুনিজম হটাতে পারলেও তারা সেক্যুলারিজম ঠেকাতে পারেনি। আমেরিকার সহায়তায় সুহার্তো ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তার প্রবর্তিত সেক্যুলারিজম এখনও সে দেশে আছে।

https://dailysangram.info/post/477141