করোনার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে রোগীর চাপ। করোনা আক্রান্ত এক রোগীকে যশোর থেকে গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
৯ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১১:৫৯

করোনা রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতালে

দেশে কয়েক দিন ধরে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর টানা দুই দিন ধরে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের বেশি। মৃত্যুও মাঝেমধ্যে বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও একই চিত্র পাওয়া গেছে।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। গতকাল শনিবার তিনি বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সব হাসপাতাল ও নার্স-চিকিৎসকরা সেবা দিতে প্রস্তুত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৯ হাজার ৫৮৬টি। তাতে শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ১১৬ জন। শনাক্তের হার ৫.৭৯ শতাংশ। আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ৫.৬৭ শতাংশ। এ নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত হলো ১৫ লাখ ৯২ হাজার ২০৯ জন। শুক্রবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে একজন। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃত্যু ২৮ হাজার ৯৯ জন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী গতকাল মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় বলেন, দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। খাবার হোটেলে টিকা সনদ ছাড়া যাওয়া যাবে না। বাস-ট্রেন-লঞ্চসহ যাত্রীবাহী সব পরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে এসব সিদ্ধান্ত দু-এক দিনের মধ্যে কার্যকর হবে।

একই দিন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আজ রবিবার কভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গতকাল সরেজমিনে রাজধানী ঢাকার তিনটি হাসপাতাল ও বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়লেও করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলায় এখনো প্রস্তুত নয় হাসপাতালগুলো। রোগী কমে যাওয়ায় করোনার বেডসংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন করে শয্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগের সংকট বিবেচনায় নিয়ে রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করারও চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল : বেশ কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন ১৫-১৬ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রোগীদের মধ্যে টিকা নিয়েছে এমন ব্যক্তিও রয়েছে। করোনার ব্যাপক সংক্রমণের সময় এই হাসপাতালে প্রায় ৯০০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড ইউনিট করা হয়। এতে সর্বোচ্চ ভর্তি ছিল প্রায় সাড়ে ৮০০ রোগী। পরে সংক্রমণ কমলে শয্যা কমানো হয়। বর্তমানে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী বাড়তে থাকায় পর্যায়ক্রমে করোনা বেডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে।

করোনার রোগী কিছুটা বাড়ায় মেডিসিন বিভাগের কয়েকটি ওয়ার্ডকে আবার করোনা ওয়ার্ড করা হয়েছে। নতুন ভবনের ছয়তলা ও সাততলায় চারটি ওয়ার্ডে করোনা বেড থাকলেও রোগী বাড়ার আশঙ্কায় অষ্টম তলার দুটি মেডিসিন ওয়ার্ড করোনার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

ঢাকা মেডিক্যালে গত বছরের জুলাইয়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল দুই হাজার ৫৯৭ জন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ ছিল এক হাজার ৪৬৮ জন। গত ডিসেম্বরে সবচেয়ে কম ৫৫২ জন ভর্তি ছিল করোনা ইউনিটে।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি দুপুর ১টা পর্যন্ত ১১৩ জন ভর্তি হয়। করোনা ইউনিটে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তি হয় ৮২০ জন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী করোনার যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে। আইসিইউও খালি আছে।’

মুগদা হাসপাতাল : রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত চার দিনে হাসপাতালটিতে করোনায় আক্রান্ত ১৩ রোগী ভর্তি হয়েছে। মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, গত বুধবার থেকে নতুন করে করোনা রোগী আসছে। এ পর্যন্ত ১৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। তাদের শারীরিক অবস্থা এখন আগের চেয়ে ভালো।

নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘করোনা রোগী বাড়লে হাসপাতালে বেডের সংখ্যাও কমে যাবে। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনো ওমিক্রন সংক্রমিত কোনো রোগী আসেনি।

কুর্মিটোলা : রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই হাসপাতালে ভর্তি রোগী ১০ জন বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগী ভর্তি ছিল ৫৭ জন। গতকাল পর্যন্ত সে সংখ্যা বেড়ে ৬৭ জন হয়েছে।

বরিশাল : বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ মোকাবেলার প্রস্তুতি নেই। পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বরিশালে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে করোনা ইউনিটের প্রতি ফ্লোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি কক্ষ, আসবাব ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তালিকা করা হচ্ছে। করোনা ইউনিটের ৩২৮টি বেড পুরোপুরি প্রস্তুত। শনিবার (গতকাল) পর্যন্ত পাঁচজন করোনা রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে আইসিইউতে একজন। অন্যদের অবস্থাও উন্নতির দিকে।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রাজীব পালিত বলেন, ‘কভিড ও নন-কভিড (সাসপেকটেড) মিলে এখন ৫৩ জন চিকিৎসাধীন আছে। এক সপ্তাহ ধরে করোনা রোগী বাড়ছে। এখন ১০০ শয্যা রাখা হয়েছে। রোগী বাড়লে শয্যা বাড়ানো হবে।’

খুলনা : দীর্ঘদিন পর আবার ব্যস্ততা বেড়েছে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের ২০০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে। গতকাল পর্যন্ত এই হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে আটজন ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন আইসিউতে। হাসপাতালের ডা. সুহাস চন্দ্র হালদার বলেন, ভর্তি রোগীরা সবাই ইয়েলো জোনের। মানুষ সচেতন হলে সংক্রমণ কম হবে।

খুলনা সিভিল সার্জন দপ্তর জানায়, খুলনার অন্য কোনো হাসপাতালে এখন করোনা রোগী ভর্তি নেই। তবে গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১১৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় পাঁচজনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীর স্বজনদের গাদাগাদি, মাস্ক ব্যবহার না করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না।

হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের চিকিৎসক আতরিয়া ভট্টাচার্য বলেন, হাসপাতালে ৩২ রোগী ভর্তি ছিল। এক সপ্তাহ আগেও ছিল সমপরিমাণ রোগী।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে রোগীর সংখ্যা এখনো তুলনামূলক কম। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ সামাল দিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টিকেই তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া একটি অক্সিজেন জেনারেটর বসানোর কাজ চলছে। আরো একটি ১০ থেকে ২০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন প্লান্ট বসাতে ঢাকায় নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।

গতকাল পর্যন্ত ৩৮ করোনা রোগী ভর্তি ছিল। করোনা উপসর্গ নিয়ে একজন মারা গেছে।

রংপুর : রংপুরের সিভিল সার্জন জানান, এখন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নয়, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ১০০ শয্যার রংপুর শিশু হাসপাতালে। এই হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মাহমুদুর রহমান রিফাত বলেন, বর্তমানে পাঁচজন করোনা রোগী ভর্তি আছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/01/09/1109171