৯ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১১:৪২

করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ

বড় ধরনের ধাক্কার শঙ্কা নতুন বছরের শিক্ষায়

খোলা রাখা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত আজ রাতে কারিগরি কমিটির বৈঠকে

আবার চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস। ১৫ সপ্তাহের বিরতির পর সংক্রমণের হার গত দুদিন ৫ শতাংশের ওপরই অবস্থান করছে। সংক্রমণ অনেকটা লাফিয়ে বাড়ছে। যেখানে ৩ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল ৩ শতাংশ; সেখানে চার দিনের ব্যবধানে পাঁচ শতাংশের ঘর ছাড়িয়ে যায়। সাধারণত এই পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নড়েচড়ে বসেছেন নীতি-নির্ধারকরা। ইতোমধ্যে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি সরকারকে কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেছে।

দু-একদিনের মধ্যে এ নিয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আসছে বলে শনিবার মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ অবস্থায় শিক্ষা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে কী ঘটবে-সেই প্রশ্নও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে শনিবার রাতেই বৈঠকে মিলিত হন শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে আজ রাতে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বসবেন তারা। এই বৈঠক থেকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক যুগান্তরকে বলেন, করোনা সংক্রমণের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে সীমিত পরিসরেই লেখাপড়া চলবে, না বন্ধ করা হবে-সেই সিদ্ধান্ত জানাবে এ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি। আমরা তথ্য সংগ্রহ ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছি। কমিটির বৈঠকের পর করণীয় জানা যাবে।

অবশ্য সর্বশেষ শুক্রবার রাতে জাতীয় পরামর্শক কমিটি যে চার দফা পরামর্শ দিয়েছে তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি নেই। কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত ও নিয়মিত নজরদারির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এছাড়া শিক্ষার্থীসহ সবাইকে দ্রুত টিকার আওতায় নিয়ে আসতে বলেছে।

অন্যদিকে এ নিয়ে শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল মার্চ মাস নাগাদ সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। কেননা গেল দুই বছরে আমাদের দেশের রেকর্ড তাই দেখা গেছে। কিন্তু জানুয়ারির গোড়াতেই বাড়তে শুরু করেছে। কাজেই পরিকল্পনা কিছুটা সমন্বয় (অ্যাডজাস্টমেন্ট) করার দরকার হবে। তবে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে চাই না। প্রতিটি শিক্ষার্থী টিকা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে। সেটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হয়তো এ ক্ষেত্রে ১২ বছরের কম বয়সি শিক্ষার্থীদের একটু অসুবিধা হতে পারে। এ বিষয়টি নিয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর প্রথম মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ পায়। এর মধ্যে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের চাপ আসে। ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। ওইদিন সংক্রমণের হার ছিল ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এরপর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধাপে ধাপে সচল হয়। যদিও এখনো সব প্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ফের করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখীই শুধু নয়, ডব্লিউএইচওর নির্ধারিত সহনীয় মাত্রাও (৫ শতাংশ) পার হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত বছর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় তখন করোনার সংক্রমণ ৭ শতাংশের বেশি ছিল। তাই এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে না। আগের মতোই শিক্ষার্থীদের ভাগ করে স্কুলে আনা হবে। এর মধ্যে কেবল পঞ্চম, নবম-দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ৪-৬ দিন স্কুলে আসবে। বাকিদের সপ্তাহে ২ দিন আনা হবে। এরপরও কারিগরি কমিটির সঙ্গে বসে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে। কেননা যখন ৭ শতাংশ সংক্রমণ সত্ত্বেও স্কুল খুলে দেওয়া হয় তখন এর গতি ছিল নিুমুখী। আর এখন সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ‘ব্লেন্ডেড’ (মিশ্র) পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। এর অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ভাগে ভাগে স্কুলে আসবে। এসে বাড়ির কাজ ও অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে যাবে। এগুলো তৈরির কাজ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনার প্রস্তুতি হিসেবে ১২ বছর বয়সি সব শিশুকে টিকা দেবে সরকার। ইতোমধ্যে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে টিকা দেওয়ার নিশ্চিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের বলা হয়েছে। বিষয়টি গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এখন থেকে ১২ বছরের বেশি বয়সি শিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে হলে করোনার অন্তত এক ডোজ টিকা নিতে হবে, না হলে স্কুলে যেতে পারবে না। জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিতে সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করতে হয়। এজন্য কিছু বিধিনিষেধ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, নিবন্ধনে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর লাগে। কিন্তু অনেকের তা নেই। তাই এ কারণে যাতে শিশুদের নিবন্ধন বিঘ্নিত না হয় সে লক্ষ্যে এই নিয়মটি তুলে দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় দেড় বছরের ছুটিতে শিক্ষার অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। অর্থনীতিসহ অন্যান্য ক্ষতি পরিমাপ করা গেলেও শিক্ষার ক্ষতি চোখে যায় না। এর ধকল দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে ভোগ করতে হবে। তাই এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট বিভিন্ন দেশে দানবীয় রূপ ধারণ করেছে। প্রতিবেশ দেশ ভারতেও ত্রাহি অবস্থা। ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবকালে উন্নত বিশ্বে নববর্ষের ছুটি চলছিল। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোথাও ছুটি বাড়িয়ে আবার কোথাও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। যেমন-কানাডাতে ছুটি ১০ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবশ্যই নিজস্ব বাস্তবতা অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো পন্থা বেছে নিতে হবে। উন্নত দেশের সবচেয়ে ভালো বিকল্প অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। বাংলাদেশে অনলাইন-দূরশিক্ষণ কোনোটিই শতভাগ সফল হয়নি। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মনোদৈহিক ও সামাজিক সমস্যাও তৈরি হয়েছে। তাই সরকার যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চায় তাহলে অবশ্যই কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ব্যাপারে। এ নিয়ে যে বিধিনিষেধ তৈরি করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর বন্ধ করা হলে বা সপ্তাহের অধিকাংশ দিন স্কুলে শিশুদের আনা না হলে তাদের লেখাপড়া যাতে স্থবির হয়ে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

বিশাল শিক্ষা প্রশাসনের মাধ্যমে অভিভাবক ও সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে সেটা সম্ভব।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে টেলিভিশন ও পরে বেতারের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ চালু করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি সমীক্ষায় সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর তথ্য পাওয়া যায়। পরে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে অনলাইনে পাঠদান প্রথা চালু হয়। কিন্তু এটাও কেবল সচ্ছল পরিবারে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এরপর প্রাথমিক স্তরে ‘বাড়ির কাজ’ আর মাধ্যমিক স্তরে অ্যাসাইনমেন্ট প্রথা চালু করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর দাবি করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো।

জানা গেছে, উভয় মন্ত্রণালয় এই একই পদ্ধতি এবারও চালু করবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘বিগত বছরে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে শিখনের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে ভালো ফল পাওয়া গেছে। সরাসরি পদ্ধতির লেখাপড়ার বিকল্প নেই। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতি শিখনফল অর্জনে অনেকটাই সহায়ক। তাই এ বছরের জন্যও আমরা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছি। আগামী সপ্তাহ নাগাদ পরিকল্পনা প্রণীত হবে। আর এ মাসের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির কাজ শেষ হবে। প্রতি সপ্তাহে আগের মতোই দুটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কাজ চলছে।’

আরও অনেক ক্ষতি হবে : এদিকে ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে লেখাপড়ার পাশাপাশি আরও কিছু ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কোভিড-১৯ মহামারিতে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এ লক্ষ্যে কিছু স্কুল বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না।

এছাড়া করোনায় শিশুদের কী পরিমাণ শিখনঘাটতি হয়েছে, সেটিও নিরূপণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেটিও বিঘ্নিত হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেবে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলক (পাইলটিং) প্রয়োগের কাজে। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের ৬০টি স্কুলে এই কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে সেটি সম্ভব হবে না। করোনার কারণে এমনিতে নতুন শিক্ষাক্রম দুই বছর পিছিয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সালে এটি পুরোপুরি প্রবর্তন হওয়ার কথা ছিল। এখন পাইলটিংয়ের ফল নিয়ে শিক্ষাক্রম তৈরি করে ২০২৩ সালে চালুর সিদ্ধান্ত আছে।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শিখনঘাটতি নিরূপণসহ অন্যান্য কাজ বিঘ্নিত তো হবেই। এ অবস্থায় বিকল্প খুঁজতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে সেটি বের করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিকভাবে প্রতি ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা। করোনার কারণে এই পরীক্ষা ইতোমধ্যে মে-জুনে নেওয়ার ঘোষণা আছে। ইতোমধ্যে এসব শিক্ষার্থীর সিলেবাস ছোট করে প্রকাশ করা হয়েছে। সেটির ওপর এখন ক্লাস চলছিল। আবার ছুটি ঘোষণা হলে এই পরীক্ষাও পেছাতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/506714